বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোখা অতিপ্রবল হয়ে কক্সবাজার উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে। কক্সবাজার উপকূল থেকে ৮৬০ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করলেও এর প্রভাবে সাগর উত্তাল হয়ে পড়ছে। জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কায় আজ শনিবার সকাল থেকে সেন্টমার্টিনের লোকজনকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে আনা হচ্ছে।
আজ সন্ধ্যায় কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিনের কাছাকাছি উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগের প্রভাব পড়তে পারে। কাল রোববার সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে ঘূর্ণিঝড়টি কক্সবাজার ও উত্তর মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করতে পারে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
কক্সবাজারে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত
আজ দুপুরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কক্সবাজারকে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ১৩ নম্বর বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপের পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারের দ্বীপ ও চরের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুট বেশি উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
আশ্রয়কেন্দ্রে সরানো হচ্ছে লোকজন
বঙ্গোপসাগরের মধ্যে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের লোকসংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। দ্বীপের অন্তত ৮ হাজার মানুষকে সরিয়ে আনার জন্য ইতিমধ্যে ৩টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রসহ দ্বীপের ৩৭টি হোটেল রিসোর্ট-কটেজ খালি করা হয়েছে।
দ্বীপের সর্বদক্ষিণের ৯ নং ওয়ার্ডের কোথাও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নেই। নেই পাকা ভবনের হোটেল রিসোর্টও। ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণপাড়া, হলবনিয়া, পুঁতকাটাবনিয়া, ডেইলপাড়াসহ ছয়টি গ্রামে প্রায় দুই হাজার মানুষের বসবাস। আজ সকাল নয়টা থেকে সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে দক্ষিণপাড়া ও হলবনিয়া গ্রাম থেকে লোকজনকে সরানো কাজ শুরু হয়েছে। সঙ্গে আগেভাগে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাওয়ার জন্য এলাকায় চালানো হচ্ছে প্রচারণা।
মাঝরাতে বৃষ্টি সেন্টমার্টিনে, বাসিন্দাদের নির্ঘুম রাত
ঘটনাস্থল থেকে ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে সাগর উত্তাল আছে। বলা হচ্ছে, সাগরে জোয়ারের পানিতে স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত ১২ ফুট পর্যন্ত জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। তখন সেন্ট মার্টিনের বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যেতে পারে। দ্বীপের দক্ষিণাংশের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে লোকজনের আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো ভবন নেই। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে সেন্ট মার্টিন সদরে দ্রুত লোকজনকে সরানোর মতো উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থাও নেই। তাই জানমালের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে প্রথমে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের লোকজনকে আশ্রয়শিবিরে সরানোর কাজ চলছে। সন্ধ্যার আগে ওই ওয়ার্ডের প্রায় দেড় হাজার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরানোর প্রস্তুতি চলছে। এরপর ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থা বুঝে অন্যান্য এলাকার লোকজনকে সরানো হবে।
ইউপির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, শুক্রবার রাতে হালকা বৃষ্টি হলেও শনিবার সকাল থেকে গুমোট অবস্থা বিরাজ করছে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত সূর্যের দেখা মেলেনি, তবে ঝড়বৃষ্টি নেই। সাগর উত্তাল রয়েছে। দ্বীপের মাছ ধরার তিন শতাধিক ট্রলার আগেভাগে টেকনাফের খায়ূকখালী খাল ও শাহপরীর দ্বীপে পাঠানো হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় মোখা আতঙ্কে সেন্ট মার্টিন ছাড়ছেন লোকজন
স্থানীয় ব্যবসায়ী নুর মোহাম্মদ (৫৫) বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা সেন্ট মার্টিনের ওপর দিয়ে মিয়ানমারে আঘাত হানবে—এমন খবরে দ্বীপের লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে আগেভাগে পরিবার নিয়ে টেকনাফে চলে গেছেন। ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হলে দ্বীপের অধিকাংশ ঘরবাড়ি বিলীন হতে পারে। কারণ দ্বীপের ৯০ শতাংশ মানুষের ঘরবাড়ি ত্রিপলের ছাউনিযুক্ত, বাঁশ ও পলিথিনের বেড়ার।
দ্বীপের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের আতঙ্কে ভুগছেন দ্বীপের হাজারো মানুষ। দুপুর ১২টা পর্যন্ত পরিস্থিতি গুমোট অবস্থায় থাকলেও লোকজন আতঙ্কে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। সেন্ট মার্টিন বাজারের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ।
ফিরোজ আহমদ খান বলেন, গত বছরে ২৫ অক্টোবরে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের জলোচ্ছ্বাসে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ তলিয়ে গিয়েছিল। এ সময় শতাধিক ঘরবাড়ি ও বিপুল নারকেলগাছ উপড়ে পড়েছিল। ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাতের সময় সাগরে পূর্ণিমা ও অমাবস্যার জোয়ারের প্রভাব থাকতে পারে। তখন জোয়ারের পানির উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২৫ ফুট বেশি হতে পারে। তখন ক্ষয়ক্ষতিও বাড়তে পারে। জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর মতো টেকসই বেড়িবাঁধ সেন্ট মার্টিনে নেই।
স্থানীয় লোকজন বলেন, ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে লোকজনকে সচেতন করতে আজ সকাল থেকে ইউনিয়নের ৯, ৮, ৭ নম্বর ওয়ার্ডে একাধিক স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। প্রচারণায় বলা হচ্ছে, ঘূর্ণিঝড় মোখা দ্রুত ধেয়ে আসছে। আরও কাছাকাছি অবস্থানে চলে এলে লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে দ্রুত চলে যেতে হবে। তাই আগেভাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, শুকনা খাবার নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে।
বেলা ১১টার মধ্যে সেন্ট মার্টিন হাসপাতাল ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন অন্তত ২০ পরিবারের ১০৪ জন। বেশির ভাগ নারী-পুরুষ। আশ্রয় নেওয়া লোকজনের দুপুরের খাবারের জন্য হাসপাতাল ভবনের নিচে কয়েকজন পুরুষ রান্নার আয়োজন শুরু করেন।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে হাসপাতালের তিনতলার একটি কক্ষে আশ্রয় নিয়েছেন দ্বীপের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা মো. ইসমাইল (৫২)। তিনি বলেন, গত বছরের অক্টোবরে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে তাঁর বাড়ি প্লাবিত হয়েছিল। তাই ঝুঁকি এড়াতে আগেভাগে আশ্রয়শিবিরে ছুটে এসেছেন। ঘূর্ণিঝড় মোখার মতিগতি ভালো মনে হচ্ছে না তাঁর।
ঝুঁকিতে সাড়ে ৮ লাখ রোহিঙ্গা ও সেন্ট মার্টিনবাসী
চার মাসের শিশুসন্তান নিয়ে বেলা ১১টার দিকে হাসপাতালে আশ্রয় নেন স্থানীয় মাঝরপাড়ার একজন তরুণী। তিনি বলেন, নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তিনি আগেভাগেই এসেছেন। বিকেলে পরিবারের আরও কয়েকজন আসবেন।
সাগর উত্তাল থাকায় সেন্ট মার্টিন-টেকনাফ নৌপথে যাত্রীবাহী নৌযানের চলাচল বন্ধ আছে জানিয়ে সেন্ট মার্টিন সার্ভিস ট্রলার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সেন্ট মার্টিনের পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে অবনতির দিকে যাচ্ছে। সাগর উত্তাল হওয়ার পাশাপাশি জোয়ারের পানির উচ্চতাও বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশ সদস্যরা প্রস্তুত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ৩টি সাইক্লোন শেল্টারসহ ৩৭টি হোটেল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তাতে সাত হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নিতে পারবেন। মানুষকে সচেতন করতে এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় থাকা লোকজনকে আগেভাগে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে আনার কাজ চলছে। সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ শুকনা খাবার মজুত রাখা হয়েছে।