সেজনি: অবসর ভেঙে ফিরে বার্সার হয়ে ইতিহাস লিখছেন যিনি

0
16
এমবাপ্পেকে ঠেকিয়ে দিচ্ছেন সেজনি, রয়টার্স

২০২৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাতের কথা। ভিয়ারিয়ালের মাঠে ভিয়ারিয়ালকে ৫-১ গোলে উড়িয়ে লিগে টানা ষষ্ঠ জয় আদায় করে নেয় বার্সেলোনা। কিন্তু জিতেও যেন স্বস্তি ছিল না বার্সা শিবিরে। হাঁটুতে মারাত্মক চোট পেয়ে যে স্ট্রেচারের করে মাঠ ছাড়তে হয়েছে গোলরক্ষক মার্ক-আন্দ্রে টের স্টেগেন। প্রথমার্ধের যোগ করা সময়ে শূন্যে লাফিয়ে বল ধরার পর পড়ে গিয়ে ডান হাঁটুতে এই চোট পান জার্মান গোলরক্ষক।

সে সময়েই বোঝা যাচ্ছিল, খারাপ কোনো খবর পেতে যাচ্ছে বার্সেলোনা। হয়েছেও তাই। জানা যায়, গুরুতর এই চোটে মৌসুম শেষ হয়ে গেছে টের স্টেগেনের। দলের প্রধান গোলরক্ষককে হারিয়ে বার্সার তখন পাগলপ্রায় দশা।

ইনিয়াকি পেনিয়া দ্বিতীয় গোলরক্ষক হিসেবে থাকলেও মৌসুমজুড়ে তাঁর ওপর আস্থা রাখা কঠিনই ছিল। আর কোনো কারণে যদি তাঁকেও হারাতে হয়, তখন কী হবে! সব মিলিয়ে বার্সার আরেকজন গোলরক্ষককে দলে টানা জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।

কিন্তু লা লিগার দলবদলের দুয়ার তখন বন্ধ হওয়ায় বিকল্প পথের সন্ধান করতে হয় বার্সাকে। এর মধ্যে একটা পথ পেয়েও যায় তারা। স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের (আরএফইএফ) বিশেষ শর্ত মেনে গোলরক্ষক ভেড়ানোর সুযোগ পায় কাতালান ক্লাবটি। শর্তটি হচ্ছে চোটাক্রান্ত খেলোয়াড়টিকে চার মাসের বেশি সময়ের জন্য মাঠের বাইরে ছিটকে যেতে হবে।

পাশাপাশি যে খেলোয়াড়টি তারা নেবে, তাঁকে ফ্রি এজেন্ট হতে হবে এবং দলবদল শেষ হওয়ার আগেই আগের ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি শেষ করতে হবে। এ ছাড়া নতুন যে গোলরক্ষককে তারা কিনবে, তাঁকে আহত গোলরক্ষকের ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন দেওয়ার অনুমতি পাবে ক্লাবটি। যেমন বার্সায় টের স্টেগেন বেতন পান বছরে ৯০ লাখ ইউরো। এখন নতুন গোলরক্ষকের বেতন হতে পারবে বছরে সর্বোচ্চ ৭০ লাখ ইউরো।

এত শর্ত মেনে খেলোয়াড় খুঁজে বের করা সহজ ব্যাপার ছিল না। কিন্তু এই কঠিন শর্তই বার্সাকে পৌঁছে দেয় ভয়চেক সেজনির কাছে। যিনি এক মাস আগে অর্থাৎ ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট জুভেন্টাসের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে চুক্তি ছিন্ন করে হয়ে যান ফ্রি এজেন্ট।

দলের সঙ্গে ট্রফি হাতে সেজনির উদ্‌যাপন, রয়টার্স

শুধু তা–ই নয়, ২৭ আগস্ট পেশাদার ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে পরিবার নিয়ে ঘুরতেও চলে যান। কিন্তু ফুটবলবিহীন আয়েশি জীবনের সুখ সেজনির কপালে সইল না। বার্সার ডাকে সাড়া দিয়ে অবসরের সিদ্ধান্ত বাতিল করে এক মৌসুমের জন্য যোগ দেন বার্সায়।

শুরুতে সবাই ভেবেছিল, সেজনি হয়তো বিকল্প গোলরক্ষক হিসেবেই খেলবেন। শুরুতে বিষয়টা তেমনই ছিল। চ্যাম্পিয়নস লিগে নিজের প্রথম ৪ ম্যাচে এবং লা লিগায় প্রথম ১২ ম্যাচে একাদশে জায়গা হয়নি তাঁর। কিন্তু একবার সুযোগ পাওয়ার পর আর জায়গা হারাননি ৩৫ বছর বয়সী এই গোলরক্ষক। বার্সার হয়ে নিজের প্রথম মৌসুমে এখন পর্যন্ত ২৬ ম্যাচ খেলেছেন তিনি, যার মধ্যে জিতেছেন দুটি শিরোপাও।

জানুয়ারিতে স্প্যানিশ সুপার কাপে রিয়ালকে হারিয়ে বার্সার হয়ে শিরোপা জিতেছিলেন সেজনি। আর গতকাল রাতে সেজনি জিতলেন কোপা দেল রের শিরোপাও। এখন নিজের প্রথম মৌসুমেই কোয়াড্রপল জেতার সুযোগ আছে সেজনির। লা লিগা ও চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা বার্সা নিজেদের করতে না পারলেই ইতিহাসের অংশ হবেন সেজনি। অবসর থেকে ফিরে আসা একজন গোলরক্ষকের জন্য এ এক অনন্য অর্জনই বটে।

এমন নয় যে সেজনি শুধু অলংকার হিসেবে দলে ছিলেন। অনেক ম্যাচে বার্সাকে বলা যায় একক কৃতিত্বে বাঁচিয়েছেন তিনি। লিসবনে বেনফিকার বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলোর প্রথম লেগের ম্যাচটির কথাই ধরা যাক। সেদিন ২২ মিনিটে পাউ কুবারসি লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়ার পর বাকি সময় ১০ জন নিয়ে খেলতে হয় বার্সাকে। সেদিন বার্সার ওপর আক্রমণে ঝড় বইয়ে দিয়েছিল পর্তুগিজ ক্লাবটি। বেনফিকা সেদিন ২৬টি শট নিয়েছিল, যার ৮টি সেভ করেছেন সেজনি।

বিশ্বকাপে মেসির পেনাল্টি রুখে দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন পোলিশ গোলকিপার ভয়চেক সেজনি, এএফপি

২০০৩-০৪ মৌসুমের পর চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচে বার্সার কোনো গোলকিপারের গোল হজম না করে সর্বোচ্চ সেভের রেকর্ডটিও সেদিন নিজের করে নেন এই পোলিশ গোলকিপার। সেজনির বীরত্বের পর সেদিন বার্সা জিতেছিল ১-০ গোলে। এমন বীরত্বপূর্ণ পারফরম্যান্স সেজনি মৌসুমজুড়ে একাধিক ম্যাচে দেখিয়েছেন। শনিবার রাতের ফাইনালেও দারুণ কিছু গোল সেভ করেন এই পোলিশ গোলরক্ষক, যার মধ্যে ভিনিসিয়ুসের বিপক্ষে ডাবল সেভ রীতিমতো নতুন প্রাণ দিয়েছে বার্সাকে। সব মিলিয়ে সেজনি এই ম্যাচে গোল বাঁচিয়েছেন ৫টি।

এমন অনেক ফুটবলার আছেন, বছরের পর বছর চেষ্টা করেও শিরোপা জিততে পারেন না। এমনকি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেও ফিরতে হয় খালি হাতে। কিন্তু সেজনি সেদিক থেকে বেশ ভাগ্যবানই বটে। বার্সায় আসার আগে আর্সেনাল ও জুভেন্টাসের হয়ে তাঁর নামের পাশে ছিল ১০ শিরোপা। বার্সায় এসে সংখ্যাটি এখন পৌঁছেছে ১২–তে। সুযোগ আছে ১৪ শিরোপা নিয়ে মৌসুম শেষ করার। আরও দুটি শিরোপা জিততে পারলে নিশ্চিতভাবে বার্সার ইতিহাসে স্থায়ী জায়গা করে নেবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.