সেই মেয়েটি এখন কোরিয়ার সবচেয়ে ধনী গায়িকা

0
19
ছোটবেলায় আইইউ। ইনস্টাগ্রাম থেকে

প্রথমে বিদ্রূপ, এরপর প্রত্যাখ্যান, তারপর প্রতারণা—সবই সইতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু মাটি আঁকড়ে পড়ে থেকে লড়াই করেই গড়ে তুলেছেন নিজের সাম্রাজ্য। কোরিয়ার এই গায়িকার গল্পটা রূপকথার চেয়ে কম কিছু নয়।
কে-পপ দুনিয়ায় চমকে দেওয়ার মতো সাফল্যের গল্পের অভাব নেই। কিন্তু আইইউর কাহিনি একটু আলাদা। যখন অনেকেই আন্তর্জাতিক খ্যাতির পেছনে ছুটেছেন, তখন তিনি থেকে গেছেন নিজের দেশে, নিজস্ব সংস্কৃতিতে। আর কোরিয়া তাঁকে ভালোবেসেছে হৃদয় দিয়ে। এখন ২০২৫ সালেও দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে ধনী গায়িকা হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন তিনি—সবার প্রিয় ‘নেশনস লিটল সিস্টার’ হিসেবে পরিচিত লি জি ইউন। যাঁকে সবাই চেনে আইইউ নামে।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে অভিষেক, কিন্তু তার পেছনে রয়েছে অনাহার, প্রত্যাখ্যান, প্রতারণা আর অসমাপ্ত বন্ধুত্বের দীর্ঘ গল্প। তবু কখনো নিজের লড়াই থামাননি।

কত আয় আইইউর
সেলেব্রিটি নেট ওয়ার্থ অনুযায়ী, ২০২৫ সালে আইইউর আনুমানিক সম্পদ ৪০ থেকে ৪৫ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে। অর্থাৎ তিনি এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী কে-পপ তারকা। সাফল্যের শুরুটা গান দিয়েই—চকচকে আন্তর্জাতিক প্রস্তাবগুলো ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অনায়াসেই।

আইইউ। শিল্পীর ফেসবুক থেকে
আইইউ। শিল্পীর ফেসবুক থেকে

গানের পাশাপাশি অভিনয়েও খ্যাতি কুড়িয়েছেন আইইউ। ‘হোটেল ডেল লুনা’,  ‘হোয়েন লাইফ গিভস ইউ ট্যানজারিনস’-এর মতো আলোচিত সিরিজে তিনি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন। শুধু নিজের গান নয়, অন্য শিল্পীদের জন্যও গান লিখেছেন ও প্রযোজনা করেছেন। বড় বড় বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের সঙ্গেও যুক্ত। এ ছাড়া বড় বড় প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান ও মুঠোফোন কোম্পানির সঙ্গেও বাণিজ্যিক চুক্তি রয়েছে তাঁর।

দারিদ্র্য, উপহাস আর প্রতারণার দিনগুলো
১৯৯৩ সালে সিউলের সঙজং-ডং-এ জন্ম আইইউর। শৈশবটা কেটেছে দারিদ্র্যে। পরিবার ঋণে ডুবে গেলে বাবা-মা আর খরচ চালাতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে আইইউ ও তাঁর ছোট ভাইকে ঠাঁই নিতে হয়েছিল দাদির ছোট, অস্বাস্থ্যকর ঘরে। সেখানেই গড়ে ওঠে তাঁর স্বপ্ন—সংগীতজগতে নাম করার।
কিশোরী অবস্থায় যেখানেই অডিশনের খবর পেতেন, ছুটে যেতেন। কিন্তু বারবার ফিরতে হতো খালি হাতে। এক ইউটিউব সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘খাবার বলতে কিছুই ছিল না। ঠান্ডা, পোকামাকড়ে ভর্তি ঘরে থাকতাম। দাদি হেয়ার ক্লিপ বিক্রি করে সংসার চালাতেন।’

অভিনেত্রী ও গায়িকা আইইউ
অভিনেত্রী ও গায়িকা আইইউ, এক্সপোর্টস নিউজ

খাবারের জন্য স্টুডিওতেই ঘুমোতেন। একসময় খাওয়াদাওয়া নিয়ে মানসিক টানাপোড়েন শুরু হয়। এসবিএসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই গায়িকা-অভিনেত্রী বলেন, ‘এতটাই চাপ ছিল যে, ছোট কোনো ব্যাপারেই শরীরে গা শিরশির করত। নিজেকেই অপছন্দ করতে শুরু করি। তখন মনে হতো আমার কেবল দুইটি কাজ আছে—ঘুমানো বা খাওয়া। খাওয়া ছাড়া আর কিছুই করতাম না।’

২০ বারের বেশি অডিশন ব্যর্থ
আইইউর নিজের আত্মীয়রাও বলতেন, তিনি গায়িকা হতে পারবেন না। কিন্তু সেটাই যেন তাঁকে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তোলে। ২০টির বেশি অডিশনে ব্যর্থ হন, এর মধ্যে জেএওয়াইপি এন্টারটেইনমেন্টও ছিল—যারা পরে প্রকাশ্যে স্বীকার করে আইইউকে ফিরিয়ে দেওয়া ছিল বড় ভুল।

আইইউ। উইকিমিডিয়া কনমস
আইইউ। উইকিমিডিয়া কনমস

তবে প্রত্যাখ্যানের চেয়েও বেশি কষ্ট দিয়েছিল প্রতারণা। ভুয়া এজেন্সিগুলো অভিনয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁর কাছ থেকে টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যেত।
শেষমেশ ১৫ বছর বয়সে লোয়েন এন্টারটেইনমেন্টে সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। প্রথম গান ‘লস্ট চাইল্ড’ দিয়ে অভিষেক হলেও খুব একটা সাড়া মেলেনি। বিষণ্ন, প্রাপ্তবয়স্কদের থিমের এই গান তখনকার জনপ্রিয় কে-পপ গানের চেয়ে ছিল একেবারে আলাদা। প্রথম মঞ্চে গান গাওয়ার সময় দর্শকেরা সরাসরি তাঁকে মঞ্চ ছাড়ার জন্য হাঁকডাক দিয়েছিলেন। অ্যালবামটিও বাণিজ্যিকভাবে ব্যর্থ হয়।
তবু থেমে থাকেননি আইইউ। ধীরে ধীরে তাঁর গান ‘বু’ আর ‘মার্শম্যালো’ জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে।

‘গুড ডে’ বদলে দিল দৃশ্যপট
২০১০ সালে মুক্তি পায় ‘গুড ডে’। গানটিতে আইইউর গায়কি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। কোরিয়াজুড়ে গানটি নিয়ে শোরগোল পড়ে যায়। সেখান থেকেই আইইউ পান ‘নেশনস লিটল সিস্টার’ খেতাব। সাফল্য ও টাকায় ঋণমুক্ত করেন নিজের পরিবারকে। তবে পড়াশোনাটা আর করা হয়নি। এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার নেই, আর পড়ালেখার যে চেষ্টা দরকার, সেটা আমি করিনি। তাই আমার জন্য নয়।’

‘হোয়েন লাইফ গিভস ইউ ট্যানজারিনস’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি
‘হোয়েন লাইফ গিভস ইউ ট্যানজারিনস’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

২০১১ সালে একের পর এক হিট ‘দ্য রেড শুজ’, ‘মাই ওল্ড স্টোরি’, ‘ফ্রাইডে’, ‘লাস্ট ফ্যান্টাসি’—সবগুলোই চার্টে শীর্ষে উঠে আসে। এমনকি বিলবোর্ড কে-পপ হট ১০০-তেও জায়গা করে নেয়। এভাবেই কে-পপ জগতে রাজত্ব করতে থাকেন আইইউ।

থেমে যাওয়া আর ফিরে আসা
২০১৭ সালে কোরীয় শিল্পী জংহিউন আত্মহত্যা করেন। ২০১৯ সালে অক্টোবরে আইইউর প্রিয় এফ (এক্স)-এর সাবেক সদস্য সুললি মারা যান। এরপর ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর আরেক গায়িকা গু হারারাও চলে যান। আইইউ ঠিক সেই মুহূর্তে ছিলেন পারফরম্যান্সে—মঞ্চে থাকতেই খবর পান। অ্যালবাম প্রকাশ স্থগিত করেন।
এ সময় ভক্তদের ভয় ছিল, আইইউ হারিয়ে যাবেন। কিন্তু কিছুটা সময় নিয়ে ফিরে আসেন আরও শক্ত হয়ে। পরের মে মাসেই বিটিএসের সুগারকে নিয়ে করেন ‘এইট’ গানটি।
২০২১ সালে তাঁর ‘সেলিব্রিটি’ গানটি টিকটকে ভাইরাল হয়। বিশ্বজুড়ে তাঁর খ্যাতি আরও বাড়ে।

চলতি বছর আইইউ অবশ্য আলোচনা অভিনয় দিয়ে। ৭ মার্চ নেটফ্লিক্সে মুক্তির পর কোরীয় সিরিজ ‘হোয়েন লাইফ গিভস ইউ ট্যানজারিনস’ নিয়ে বিস্তর চর্চা হয়েছে। ১৬ পর্বের সিরিজটি টানা অনেক দিন নেটফ্লিক্সের টপ চার্টের শীর্ষে ছিল। এই সিরিজে অভিনয় করে বিশ্বজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পান আইইউ ও পার্ক বো-গাম।

তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.