সুদানে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে দুই বাহিনীর লড়াইয়ের মধ্যে বাংলাদেশের হাজার দেড়েক নাগরিক আটকা পড়েছেন। সুদানের সামরিক বাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) লড়াইয়ের শুরুতেই ১৫ এপ্রিল রাজধানী খার্তুমে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত (চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স) তারেক মোহাম্মদের বাসায় আঘাত হানে মেশিনগানের গুলি। এক সপ্তাহ পর, ২২ এপ্রিল বিবদমান দুই পক্ষের লড়াইয়ের সময় বাংলাদেশ দূতাবাসের জানালা ও দেয়াল ভেদ করে মেশিনগানের গুলি ঢুকে পড়ে। তবে গোলাগুলির এই দুই ঘটনায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কেউ হতাহত হননি।
সুদানের বাংলাদেশ দূতাবাস ও ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে সুদানের রাজধানী খার্তুমের বাইরে গিয়ে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের নিরাপদে দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুদানে সংঘাত শুরুর পর থেকে ঢাকার সঙ্গে খার্তুমে বাংলাদেশ দূতাবাসের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের কূটনীতিকদের দেশে ফেরত পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত খার্তুমে অবস্থান করে কাজ চালিয়ে গেছেন। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় তিনি গত রোববার খার্তুম থেকে প্রায় আড়াই শ মাইল দূরের জাজিরা প্রদেশের মাদানি শহরে অবস্থান করছেন। সেখানে অবস্থান করেই বাংলাদেশের নাগরিকদের নিরাপদে ফেরানোর প্রক্রিয়ায় যুক্ত আছেন।
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত তারেক মোহাম্মদ গত সোমবার সবশেষ বার্তায় পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিনটি বিকল্পের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি সুদানে অবস্থান করেই বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টিতে জোর দিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, আপাতত খার্তুম থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে আগ্রহী লোকজনকে বাসে করে পোর্ট অব সুদানে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এরপর জাহাজ বা ফেরিতে করে তাঁদের সৌদি আরবে সরিয়ে নেওয়া হবে। সেখান থেকে তাঁদের দেশে ফেরত আনা হবে।
সূত্রটি জানায়, এখন পর্যন্ত চার শতাধিক বাংলাদেশি সুদান থেকে দেশে ফিরতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। গত দুই দিনে সেখানে গোলাগুলি অনেকটা কমেছে। এই পরিস্থিতিতে প্রথম দফায় পাঁচ শ বাংলাদেশিকে ফেরানোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
যেভাবে খার্তুম থেকে বের হলেন রাষ্ট্রদূত
আজ মঙ্গলবার দুপুরে খার্তুমে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত তারেক মোহাম্মদের সঙ্গে ফোনে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি জানান, তাঁর বাসা ছিল বিমানবন্দর ও সামরিক ঘাঁটির কাছাকাছি। অর্থাৎ লড়াইয়ের একেবারে কেন্দ্রে।
বাসায় ও দূতাবাসে হামলার বিষয়ে তারেক মোহাম্মদ বলেন, ‘আমার বাসায় মেশিনগানের গুলির আঘাত হানার পরও আমরা খার্তুমে বসে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ২০ এপ্রিল ইউরোপের এক বন্ধুপ্রতিম দেশের পরামর্শে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মিশন ও বাসা ছেড়ে রীতিমতো অজানার উদ্দেশে যাত্রা করি।’ তিনি বলেন, একই গাড়িতে স্ত্রী, সহকর্মী ও তাঁদের পরিবারের সদস্য মিলিয়ে সাতজন যাত্রা করেছিলেন। এলাকা ছিল জনশূন্য। একটু পরপরই আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করছেন। গন্তব্য অজানা থাকলেও একপর্যায়ে ঠিক হলো দূতাবাসের তৃতীয় সচিব এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা যে এলাকায় থাকেন, সেখানে যাওয়া হবে।
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানান, ১৯ এপ্রিল অস্ত্রবিরতি ছিল; ওই সময় মালয়েশিয়া দূতাবাসের একটি গাড়িতে দেশটির পাঁচ কূটনীতিক বিমানবন্দর রওনা হয়েছিলেন। পথে আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের পথরোধ করেন। মালয়েশিয়ার কূটনীতিকেরা আরএসএফ সদস্যদের কাছে তাঁদের আটকানোর কারণ জানতে চান। তখন ক্ষুব্ধ সুদানের আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা মালয়েশিয়ার কূটনীতিকদের মুঠোফোন কেড়ে নেন। এরপর তাঁদের গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে মিশনে ফিরতে বাধ্য করেন।
তারেক মোহাম্মদ বলেন, ‘মালয়েশিয়ার কূটনীতিকদের সঙ্গে আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বিষয়টি আমাদের জানা ছিল। তাই ২০ এপ্রিল রাস্তায় আরএসএফ সদস্যরা আমাদের থামালে তাঁদের কথামতো গাড়ি থেকে নেমে যাই। আমাদের মুঠোফোনও তাঁদের দিতে হয়েছিল। পরে আমাদের সুদানি চালক তাঁদের সঙ্গে কথা বলার পর আমাদের ছেড়ে দেন। ওই দিন বাসা ও দূতাবাস থেকে দূরে আমরা অবস্থান করি। ২২ এপ্রিল আমরা আবার খার্তুমে ফিরে যাই। কারণ, পাসপোর্ট এবং প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র বাসা ও অফিসে রয়ে গেছে। খার্তুমে ফিরে দেখি যে ভবনে আমাদের বাসা, তার পুরোটাই খালি। নিরাপত্তাকর্মীরাও চলে গেছেন। এমন একটা অবস্থায় খার্তুম থেকে দূরে সরে যাওয়াটাই সমীচীন মনে হলো।’
খার্তুম থেকে ২৪০ কিলোমিটার দূরে মাদানি শহর। এখানেই ২০১৯ সালে তুলা প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ–সুদান কটন অ্যান্ড জিনিং ইন্ডাস্ট্রিজ চালু করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী আবুল খায়ের। মূলত তাঁর উদ্যোগে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত, তাঁর স্ত্রী এবং মিশনের অন্যদের এই শহরে সরিয়ে আনা হয়েছে।
আবুল খায়ের আজ সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘গত দুই দিন লড়াই তুলনামূলকভাবে কম হলেও খার্তুমের পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছিল। তাই ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের অনাগ্রহ সত্ত্বেও তাঁকে রাজধানী ছাড়তে অনুরোধ করি। কারণ, উনি নিরাপদে না থাকলে অন্যদের সহযোগিতা করার সুযোগ পাবেন না।’
আবুল খায়ের বলেন, ‘প্রথমে খার্তুমে গাড়ি পাঠিয়ে রাষ্ট্রদূতসহ কর্মকর্তাদের নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। জানা গেল, আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা গাড়ি ছিনিয়ে নিয়ে তা লড়াইয়ে ব্যবহার করেন। পরে একটি ভাড়া করা পুরোনো হাইয়েস গাড়িতে চড়ে তাঁরা বাসস্টেশনে এলেন। সেখান থেকে আমাদের প্রতিষ্ঠানের পিকআপ ভ্যানে করে তাঁদের আমাদের এখানে নিয়ে এসেছি।’
এদিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম সন্ধ্যায় এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, সুদানে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদের নিরাপদে অন্য দেশের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম শুরুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। খার্তুমে বাংলাদেশ দূতাবাস ইতিমধ্যে এই বার্তা সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রচার শুরু করেছে।