রানি সিলভিয়ার জন্ম জার্মানিতে। তাঁর বাবার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন থেকেই উঠছিল নাৎসি সম্পৃক্ততার অভিযোগ। আর বরাবরই এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না দাবি করে আসছিলেন রানি। পরে অবশ্য নিজেই তদন্তের আদেশ দেন আর অভিযোগ প্রমাণিতও হয়। কিন্তু সেটা এখানে আলোচনার বিষয় নয়। ওই বিদ্রূপাত্মক শিল্পকর্মে নিজের অতীত লুকানোর চেষ্টার উপস্থাপন একেবারেই পছন্দ হয়নি রানির।
তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করেন সুইডেনের প্রেস ওমবুডসম্যানের কাছে। প্রেস ওমবুডসম্যান হলো একটি স্বতন্ত্র সংগঠন, যা সুইডিশ গণমাধ্যমে প্রকাশিত যেকোনো আধেয়র বিরুদ্ধে অভিযোগের সমাধান করে থাকে। যাহোক, এবার প্রেস ওমবুডসম্যান এই অভিযোগ বাতিল করলেন। রানি গেলেন প্রেস কাউন্সিলের কাছে, সেখানেও তাঁর হার হলো। একজন গণব্যক্তিত্ব হিসেবে রানিকে নিজের কৃতকর্মের দায়িত্ব নিতে হবে এবং বিদ্রূপ মোকাবিলা করতে হবে, এটাই ছিল তাঁদের যুক্তি।
এবার সত্যি করে বলুন তো, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে এ ধরনের বিদ্রূপ করার ক্ষমতা কোনো সাংবাদিকের হবে কি? এমনকি ব্রিটেনেও রাজকীয় ব্যক্তিত্বদের নিয়ে এ ধরনের বিদ্রূপ বা কটাক্ষের কোনো সুযোগ নেই। তাহলে সুইডেনে কী করে এটা সম্ভব হলো?
এটা সম্ভব হয়েছে দেশটির সাংবিধানিক আইনের কারণে। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে সুইডেনে ফ্রিডম অব দ্য প্রেস অ্যাক্ট বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আইন পাস হয় ১৭৬৬ সালে। এই আইন পাসের ফলে ছাপা হয় এমন যেকোনো কিছু সেন্সরশিপের আওতাবহির্ভূত হয়। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় যেকোনো তথ্যে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরও গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ করে তোলাই ছিল এই আইন পাসের উদ্দেশ্য। সেই আইনের মূলনীতি বলবৎ রেখেই সুইডেনে এখনো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আইন রয়েছে।
দেশটিতে সাংবাদিকেরা যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে যেকোনো তথ্য চাইতে পারেন, যেকোনো সরকারি স্থাপনা ও অনুষ্ঠানে তাঁদের প্রবেশগম্যতা রয়েছে এবং প্রায় যেকোনো কিছু ছাপতে পারেন। দেশটিতে এখন পর্যন্ত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে জয়ের কোনো নজির নেই। দেশটিতে প্রেস ওমবুডসম্যান ছাড়াও রয়েছে প্রেস কাউন্সিল, সুইডিশ রেডিও ও ব্রডকাস্ট অথরিটি, যারা সবাই গণমাধ্যমসংক্রান্ত নানা অভিযোগের সুরাহা করে থাকে। সেই সঙ্গে দেশটির চ্যান্সেলর অব জাস্টিসও গণমাধ্যমের বিষয়ে আলাদা জোর দেয়।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা: বাংলাদেশকে আর কত নিচে নামাবেন
মুক্ত সাংবাদিকতার এই চর্চা দেশটির রাষ্ট্রকাঠামোতে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতের দীর্ঘ ঐতিহ্য গড়ে তুলেছে। কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য একটি দেশে সাংবাদিকতা কত বড় ভূমিকা পালন করে, তাঁরা তা বুঝতে পেরেছিলেন প্রায় সাড়ে তিন শ বছর আগে। আর সেই অনুধাবনই আজ একটি গণবান্ধব রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। যে ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীনদের চোখরাঙানির ভয়ে কুঁচকে থাকতে হয় না। বরং চোখে চোখ মিলিয়ে প্রশ্ন করা যায়, সে প্রশ্নের জবাবও আদায় করে নেওয়া যায়। সত্যিকার অর্থেই সাংবাদিক হয়ে উঠতে পারে সমাজের অতন্দ্রপ্রহরী।