বিশ্বের প্রযুক্তিকেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রতিষ্ঠান অ্যাস্টেরা ল্যাবসে চাকরি পেয়েছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) প্রাক্তন শিক্ষার্থী মো. ইরফান উদ্দীন। ৯ ধাপে ইন্টারভিউ দেওয়ার পর গত ২১ মে তিনি নিয়োগপত্র হাতে পান। ইলেকট্রিক্যাল প্রোডাক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আগামী সোমবার (৩০ জুন) যোগদান করবেন ইরফান। তিনি বছরে বেতন পাবেন ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এছাড়া কোম্পানি সাইনিং বোনাস হিসেবে প্রথম বেতনের সঙ্গে প্রায় ৩০ লাখ টাকা পাবেন।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) থেকে ২০১৬ সালে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক করার পর ২০২৩ সালে বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যান ইরফান। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইয়োমিং থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেন।
মো. ইরফান উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইয়োমিংয়ে আমার মাস্টার্স ডিগ্রি ২০২৫ সালের মে মাসে শেষ হয়। কিন্তু চাকরি খোঁজার শুরুটা আরও আগে, জানুয়ারি থেকেই। প্রথম দিকে সাড়া না পেয়ে হতাশ হয়েছিলাম। কিন্তু হাল ছাড়িনি। ক্লাস, পরীক্ষা, গবেষণা—সবকিছুর পরেও প্রতিদিন প্রায় দুই ঘণ্টা আলাদা সময় রেখেছিলাম চাকরির আবেদনের জন্য। ফেব্রুয়ারি থেকে ইন্টারভিউয়ের জন্য কল পেতে শুরু করি, কিন্তু প্রথম চাকরির অফার পেতে আমাকে মে মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। মে মাসের মাঝামাঝি টেক্সাসের একটি কোম্পানি থেকে আমি প্রথম অফার পাই। পাশাপাশি আরও একাধিক কোম্পানির বিভিন্ন ধাপের ইন্টারভিউ চলছিল। অবশেষে ২১ মে একই দিনে আমি আরও দুটি অফার পাই—একটি ফক্সকন থেকে, অন্যটি সিলিকন ভ্যালির এআই কোম্পানি অ্যাস্টেরা ল্যাবস থেকে। আমি অ্যাস্টেরা ল্যাবসে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি এক হাজারেরও বেশি চাকরিতে আবেদন করেছি, আর এই চাকরিটিই ছিল সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সেরা।
চাকরির বাছাইপ্রক্রিয়া সম্পর্কে ইরফান উদ্দীন বলেন, অ্যাস্টেরা ল্যাবসে আমাকে মোট ৯টি ধাপে ইন্টারভিউ দিতে হয়েছিল।সবগুলোই ছিল টেকনিক্যাল। এর মধ্যে ৭টি ইন্টারভিউ একদিনে টানা প্রায় ৫ ঘণ্টা ধরে চলেছিল। এটি ছিল অনসাইট ইন্টারভিউ। এজন্য ওয়াইয়োমিং থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় যেতে হয়েছিল। তাই এই ধরনের ইন্টারভিউয়ের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি থাকা জরুরি। অনেকেই হয়তো ভাবেন, বাংলাদেশের কাজের অভিজ্ঞতা যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি পেতে কাজে লাগে না। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিক যে কোনো অভিজ্ঞতাই বিদেশে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
অ্যাস্টেরা ল্যাবসে বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে ইরফান বলেন, নিয়োগপত্র অনুসারে আমি বছরে সাড়ে তিন কোটি টাকা বেতন পাবো। কোম্পানি সাইনিং বোনাস হিসেবে প্রথম বেতনের সঙ্গে প্রায় ৩০ লাখ টাকা (২৫,০০০ ডলার) দেবে। এর সঙ্গে আরও সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, যেমন স্টক ও বীমা ইত্যাদি। যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত ইন্টারভিউয়ের প্রথম ধাপে আবেদনকারীকে জিজ্ঞেস করা হয়, কতো বেতন প্রত্যাশা করেন। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটা পরে এসেছিল। যদি আমাকে প্রথমে বেতনের কথা জিজ্ঞেস করা হতো, আমি নিশ্চিত এতো বেশি বেতন কখনোই চাইতাম না। পরবর্তী আবেদনে একটি কৌশল নিয়েছিলাম—প্রথমেই জিজ্ঞেস করতাম, এই পদের জন্য নির্ধারিত বেতনের পরিসীমা কত। কিন্তু প্রথম দিকের আবেদনের সময় নিজেই নির্দিষ্ট একটা বেতন বলে দিতাম।
বাংলাদেশ থেকে সিলিকন ভ্যালিতে যাত্রা সম্পর্কে মো. ইরফান উদ্দীন বলেন, চুয়েটে স্নাতক শেষ করার পর ঠিক করেছিলাম দেশেই ক্যারিয়ার গড়ব। আমি চাকরি খুঁজছিলাম, কিন্তু পাচ্ছিলাম না, এবং বেশ কিছুদিন বেকার ছিলাম। অবশ্য পরবর্তীতে চাকরি পাই এবং সর্বশেষ ওয়ালটনে চাকরি করি। সেখানকার অভিজ্ঞতা আমার বর্তমান চাকরি পেতে অনেক কাজে লেগেছে। ব্যক্তিগত কারণে বিদেশে উচ্চশিক্ষার সিদ্ধান্ত নিই। এরপরই আমি যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। ২০২৩ সালের আগস্টে বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসি। যে কোনো ইঞ্জিনিয়ারের মতো আমারও স্বপ্ন ছিল একদিন সিলিকন ভ্যালিতে চাকরি করার।
মো. ইরফান উদ্দীনের বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ধর্মপুর গ্রামে। ধর্মপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। উভয় পরীক্ষাতেই জিপিএ ছিল ৫.০০। এরপর চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) থেকে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। স্নাতকে সিজিপিএ ছিল ২.৯৮।
স্নাতকে কম সিজিপিএ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্কলারশিপ পাওয়ার বিষয়ে ইরফান উদ্দীন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ফুল ফান্ডিং স্কলারশিপ পাওয়ার জন্য সিজিপিএ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার জন্য যখন প্রস্তুতি শুরু করেছিলাম, তখন আমার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, কম সিজিপিএ এবং গবেষণাপত্র না থাকা। তাই আমি বিকল্প পথ খুঁজতে শুরু করি এবং গ্র্যাজুয়েট রেকর্ড এক্সামিনেশন (জিআরই) পরীক্ষার জন্য মনোযোগ সহকারে প্রস্তুতি নিতে থাকি। জিআরইতে আমার স্কোর ছিল ৩৩১। এটি তুলনামূলক ভালো স্কোর। যুক্তরাষ্ট্রে ফুল ফান্ডিং স্কলারশিপ পেতে জিআরই স্কোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
আব্দুর রাজ্জাক সরকার
ঢাকা