প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত মহিউদ্দিন আহমদের প্রতিনায়ক: সিরাজুল আলম খান বইয়ের পাঠপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সিরাজুল আলম খান এবং জাসদ সম্পর্কে লেখক ও গবেষক মোরশেদ শফিউল হাসান তাঁর পর্যালোচনা ও জিজ্ঞাসা তুলে ধরেছেন এই লেখায়। দুই পর্বের লেখাটির প্রথম কিস্তি আজ প্রকাশিত হলো।
বন্ধু, ঘনিষ্ঠ ও পরিচিতজন যাঁরা একসময় জাসদ ছাত্রলীগ করতেন এবং পরে জাসদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন বা তার কমবেশি সমর্থক ছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে দীর্ঘ সময় ধরে—আমি নই শুধু, আমরা অনেকেই একটা ধারণা পেয়ে এসেছি যে প্রকাশ্য নেতৃত্বে না থাকলেও সিরাজুল আলম খানই হলেন জাসদের রাজনীতির মূল লোক। নেপথ্যে থেকে তিনিই আসলে দলীয় নীতি ও কৌশল নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন। ১৯৮০–এর দশকে জাসদের ভাঙন, বাসদের জন্ম ইত্যাদির পরও কোনো অংশেরই নেতা, কর্মী বা সমর্থক কাউকে তাঁদের অতীত রাজনীতির প্রশ্নে সিরাজুল আলম খানের এই লিগ্যাসি অস্বীকার করতে বা এ নিয়ে প্রশ্ন বা সমালোচনামুখর হতে তেমন দেখিনি।
বরং ১৯৭০–এর দশকে তাঁদের কারও কারও কথাবার্তা শুনে মনে হতো, চীনে যেমন মাও সে–তুং কিংবা কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রো, তেমনি বাংলাদেশেও মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের বিকাশমান তত্ত্বের তাত্ত্বিক হলেন সিরাজুল আলম খান। শিবদাস ঘোষের (সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়া বা এসইউসি) নাম তখনো তাঁদের মুখে সেভাবে উচ্চারিত হতে শুনিনি বা দলীয় কোনো লিটারেচারে (রাজনৈতিক সাহিত্য) উল্লেখিত হতে দেখেছি বলেও মনে করতে পারি না। বরং অত্যুৎসাহী কেউ কেউ (তাঁদের মধ্যে আমাদের এক জাসদ সমর্থক কবি বন্ধুও ছিলেন) এমন কথাও বলতেন যে ‘দাদা’র রচনাসম্ভার যবে প্রকাশিত হবে, দেখে আমাদের বিস্ময়ের সীমা থাকবে না।
যদিও সাম্প্রতিক কিছু বছরে সিরাজুল আলম খানের রচিত যেসব পুস্তিকা (ড. জিল্লুর রহমান খানের সঙ্গে যৌথ নামে প্রকাশিত একটি বইয়ের কথা বাদ দিলে) দেখার আমাদের সুযোগ হয়েছে, তা মূলত দফাওয়ারি কিছু দাবিনামা বা পরামর্শ/প্রস্তাবের তালিকা। ১৯৮০–এর দশকের শেষ দিকে একবার কি দুবার সাক্ষাতে তিনি নিজেই আমাকে এমন একটি কি দুটি পুস্তিকা উপহার দেন বলে মনে আছে।
১৯৬০–এর দশকে সিরাজুল আলম খানের উদ্যোগে এবং তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতার একটা প্রচেষ্টার কথা ‘নিউক্লিয়াস’ পরিচয়ে ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে (যদিও এই নিউক্লিয়াস নামটি স্বাধীনতা–পরবর্তীকালে দেওয়া)। তবে এটাকে যেভাবে এতকাল স্বাধীনতার প্রথম উদ্যোগ বলে মূলত সিরাজুল আলম খানের অনুসারীদের মাধ্যমে প্রচার ও প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে, তার যথার্থতা এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। নিউক্লিয়াসের গঠন ও তৎপরতা সম্পর্কে মৌখিক ও লিখিত যা কিছু বিবরণ আমরা এত দিন পেয়ে এসেছি, তার সূত্র ছিলেন সিরাজুল আলম খানের ভক্ত ও অনুসারীরা। আর তাঁদের তথ্যের উৎস হয়তো ছিলেন সিরাজুল আলম খান নিজেই। এগুলো হলো তিনি, মানে আড্ডায়-আলোচনায় কিংবা বিভিন্ন সময় জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে তাঁর কাছ থেকে যা কিছু শোনা বা জানা গেছে।
কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত মহিউদ্দিন আহমদের প্রতিনায়ক গ্রন্থে খোদ সিরাজুল আলম খান, তাঁর সে সময়ের (নিউক্লিয়াস পর্বের) সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহকর্মী আব্দুর রাজ্জাক এবং সমসাময়িক অন্য ছাত্র ও রাজনৈতিক সহকর্মীদের যেসব সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে, তাতে এতকাল শুনে আসা আখ্যানের সঙ্গে কিছু কিছু গরমিল পাওয়া যায় (অন্য সব ক্ষেত্রে বা সবার বেলায় যেমন, তেমনি এ ক্ষেত্রেও হয়তো কল্পনার—সত্যি ঘটনার সঙ্গে অতিকথার—ইতিহাসের সঙ্গে মিথের কমবেশি সংমিশ্রণ ঘটেছে)। তবে সে বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে এখানে অন্য কিছু প্রশ্নে আমার আলোচনাকে কেন্দ্রীভূত করতে চাই।.
বছর কয়েক আগে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সামান্য অনুসন্ধান বিশেষ করে ১৯৬০–এর দশকের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আমি নিজে (এবং কাছাকাছি সময়ে আমার মতো আরও অনেকেই) যেসব তথ্যের মুখোমুখি হই তা হলো, ১৯৬০–এর দশকজুড়েই পাকিস্তানি শাসনের নিগড় থেকে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে দেশে ও বাইরে অনেকগুলো উদ্যোগ সক্রিয় ছিল। এর মধ্যে কিছু প্রচেষ্টার সূত্রপাত হয় ১৯৬০–এর দশকের গোড়াতে এমনকি তার আগেও। যেমন: ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন পার্টি/ফ্রন্ট (১৯৫৯), ইনার গ্রুপ (১৯৬১/৬২), বেঙ্গল লিবারেশন অ্যাসোসিয়েশন (১৯৬০/৬১), বঙ্গবাহিনী (১৯৬২), অপূর্ব সংসদ (১৯৬২), নিউক্লিয়াস বা ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী গ্রুপ (১৯৬২), লন্ডনে ইস্ট পাকিস্তান হাউস কেন্দ্রিক প্রবাসী বাঙালি ছাত্রদের একটি উদ্যোগ (১৯৬২) প্রভৃতি।
সামরিক বাহিনীর ভেতরে বাঙালি সেনাদের সশস্ত্র বিদ্রোহ প্রচেষ্টাটি (যাকে উপলক্ষ করে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে) কিছু পরের (১৯৬০–এর দশকের শেষার্ধের) ঘটনা, সুতরাং সেটিকে আমি এই হিসাবে আনছি না। মোটকথা, দেখা যাচ্ছে, একসময় জাসদ সমর্থকদের তরফে যেভাবে বা যতটা প্রচারিত হয়েছে, সে অর্থে নিউক্লিয়াস মোটেও স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রথম উদ্যোগ নয়, একমাত্র তো নয়ই। হয়তো সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী বা টেকসই প্রচেষ্টা বলা যায় একে। আবার স্বাধীনতার প্রশ্নে ছাত্রলীগের দুটি ধারা বা স্পষ্ট বিভাজনের কথাও যেভাবে বলা হয়, প্রাপ্ত তথ্য ও সাক্ষ্যও তাকে নিঃসংশয় স্বীকৃতি দেয় না। মহিউদ্দিন আহমদের নেওয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে দেখা যায়, স্বাধীনতার লক্ষ্যে উপরোল্লিখিত প্রচেষ্টাগুলোর কোনো কোনোটির সঙ্গে শাহ মোয়াজ্জেম বা শেখ মণির মতো ‘অবিপ্লবী’রাও যুক্ত হয়েছেন, অন্তত যখন বা যে পর্যায়ে তাঁরা বুঝতে পেরেছেন যে সে প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অনুমোদন বা সমর্থন রয়েছে।
ওপরে উল্লেখিত স্বাধীনতার উদ্যোগ বা প্রচেষ্টাগুলোর কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কথা এখানে তুলে ধরা যেতে পারে:
ক. এগুলোর বেশির ভাগ বা প্রায় সব কটি উদ্যোগের সঙ্গে আগে বা পরে শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ ছিল। অন্তত তিনি সে ব্যাপারে কমবেশি অবহিত ছিলেন। কয়েকটি প্রচেষ্টায় তাঁর গোপন পৃষ্ঠপোষকতা এমনকি প্রত্যক্ষ সম্পৃক্তি বা ব্যক্তিগত অংশগ্রহণের কথাও জানা যায়। যেমন একটি ঘটনার কথা এখন নানা সাক্ষ্য-প্রমাণে মোটামুটি সুপ্রতিষ্ঠিত যে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর যখন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং তার মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে থেকে গণতান্ত্রিক উপায়ে বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের সম্ভাবনা তিরোহিত হয়ে গেল, তখন শেখ মুজিব একবার গোপনে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন, পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার প্রচেষ্টায় ভারতের সম্ভাব্য সাহায্য-সহযোগিতার বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে। তবে সেবার ভারত সরকারের তরফে কার্যকর কোনো সহযোগিতার আশ্বাস ছাড়াই তাঁকে দেশে ফিরতে হয়। আর ফিরেই পরদিন তিনি গ্রেপ্তার হয়ে যান।
খ. দ্বিতীয় যে সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই তা হলো, উপরিউক্ত অধিকাংশ প্রচেষ্টায়ই উদ্যোক্তারা (এমনকি প্রবাসী বাঙালি তরুণেরাও) নিকট ও শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারতের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়েই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। এ ব্যাপারে ‘নিউক্লিয়াস’-এর নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা কী ছিল (তাঁরা কি গণ–অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নাকি সশস্ত্র বিদ্রোহ বা আন্দোলনের মাধ্যমে এই স্বাধীনতা অর্জন করতে চেয়েছিলেন), স্বাধীনতা–পূর্বকালে প্রকাশিত তাঁদের কোনো দলিল বা প্রচারপত্র কিংবা স্বাধীনতা-উত্তরকালে সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমদের কোনো লেখা, সাক্ষাৎকার বা অন্য কোনোভাবে দেওয়া বক্তব্য থেকে কি তার সামান্যতম ধারণা পাওয়া যায়? এযাবৎ বিষয়টি নিয়ে বইপত্র যা লেখা হয়েছে, তাতে কেবল নেতাদের জবানিতে কিছু গোপন বৈঠক, যোগাযোগ এবং ছাত্রলীগের ভেতরে গ্রুপের শক্তি বৃদ্ধি, কমিটি দখল ইত্যাদির তথ্যই পাওয়া যায়।
গোড়া (অর্থাৎ ১৯৪৭–এর পর) থেকেই পূর্ব বাংলার বিচ্ছিন্নতা বা স্বাধীনতা, কিংবা আরও সঠিক অর্থে বললে, পাকিস্তানের খণ্ডীকরণের বিষয়ে ভারতের আগ্রহের কমতি ছিল না। সেদিক থেকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা প্রচেষ্টার প্রতি তাদের মনোভাব সব সময়ই ইতিবাচক ছিল বলা যায় (একই রকম মনোভাব তারা পোষণ করত পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলেও পাখতুন, বালুচ বা সিন্ধি জাতিসত্তার স্বাধীনতা প্রয়াসের প্রতিও)। তবে কিছু লোকের বিচ্ছিন্ন তৎপরতার প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন দিয়ে এ ব্যাপারে বড় রকমের ঝুঁকি নিতে ভারত স্বভাবতই চায়নি। তা ছাড়া ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নানা সমীকরণও দিল্লির নেতাদের বিবেচনায় রাখতে হয়েছিল। মোটকথা, এ বিষয়ে তাঁদের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট সাবধানী। এর জন্য ১৯৭১–এর মার্চ পর্যন্ত তাঁদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তবে এর আগে গোয়েন্দা এবং গোপন কূটনৈতিক সূত্রে কিছু কিছু যোগাযোগ বা তৎপরতা যে একবারে চলেনি, তা–ও নয়। চলেছিল যে তার কিছু কিছু সাক্ষ্য আজ আমরা দু-একজন সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক যাঁরা এসব তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের স্মৃতিচারণামূলক রচনা বা সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পারি। যদিও তাঁদের দেওয়া বিবরণও যে পুরোপুরি অভ্রান্ত বা সন্দেহের ঊর্ধ্বে, তা–ও বলা যাবে না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কার্যকর সংযোগ রক্ষার কাজটি করতেন চিত্তরঞ্জন সুতার। কারামুক্তির পর ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবের নির্দেশে কিংবা হয়তো নিজ সিদ্ধান্তেই যিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানকার ভবানীপুরের রাজেন্দ্র রোডে একটি বিরাট বাড়ি ভাড়া নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস ও তৎপরতা চালাতে থাকেন (পরে ১৯৭১ সাল অবধি তাঁর উদ্যোগে বনগাঁ, আগরতলা, শিলিগুড়িতেসহ এ রকম আরও কয়েকটি বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়)। ভারতে চলে যাওয়ার পরও ১৯৭৩–এর নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের টিকিটে পিরোজপুর থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এমনকি ১৯৭৫ সালে তাঁকে বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাত্র চার দিন আগে চিত্ত সুতার কলকাতায় ফিরে যান। এর সপ্তাহ দুই আগে ঢাকা থেকে কলকাতায় উপস্থিত হন সিরাজুল আলম খানও।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত চিত্তরঞ্জন সুতার বিভিন্ন সময় তফশিলি ফেডারেশন, ন্যাপ ইত্যাদি দলের সঙ্গে যুক্ত হলেও তাঁর মূল লক্ষ্য বা স্বপ্ন ছিল পূর্ব বাংলার নিপীড়িত হিন্দুদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, যা পরে ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’ আন্দোলনে রূপ নেয়। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি ডা. কালিদাস বৈদ্যকে নিয়ে জাতীয় গণমুক্তি দল নামে একটি রাজনৈতিক দলও গঠন করেন (যদিও দলের সম্মুখসারির নেতা পদে সুতার থাকেননি, মূল লোক হয়েও তাঁর ভূমিকা ছিল নেপথ্যে)। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এই দলটি থেকে কয়েকজন প্রার্থীও হয়েছিলেন, যদিও বলা বাহুল্য, তাঁদের কেউ জয়ী হতে পারেননি। পরে এই দলটি আওয়ামী লীগে বিলীন হয়ে যায়। এর আগে তাঁরা ৬–দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন। তাঁরা মনে করেছিলেন, ৬-দফাভিত্তিক পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবির মধ্যেই তাঁদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের ইঙ্গিত আছে। ১৯৬৬-৬৭ সালে ঢাকা জেলে বন্দী অবস্থায় শেখ মুজিবের কাছাকাছি (২০ নং) সেলে থাকার সুবাদে তাঁর সঙ্গে গড়ে ওঠা সৌহার্দ্যের পরিপ্রেক্ষিতে এবং পারস্পরিক স্বার্থ বা প্রয়োজনের নিরিখে চিত্ত সুতার হয়তো পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে থেকে কাজ করাকেই অধিক সুবিধাজনক বিবেচনা করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মুক্তিবাহিনীর বাইরে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে সে দেশের গোয়েন্দা (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং সংক্ষেপে ‘র’) কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে আলাদাভাবে বিএলএফ বা ‘মুজিব বাহিনী’ গঠন, তাদের বিশেষ রাজনৈতিক ও সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ইত্যাদির ব্যাপারে চিত্ত সুতারের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এ সময় ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনিই। আর এ পর্যায়ে সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ সবাই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এই স্বতন্ত্র প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, এমনকি জাসদ দল গঠন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে তারা সংঘাতমূলক অবস্থানে যাওয়ার পরও, চিত্ত সুতারের সঙ্গে সিরাজুল আলম খান ও মুজিব বাহিনীতে তাঁর শিষ্য বা অনুসারীদের এই যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। সিরাজুল আলম খান কলকাতায় গেলে এসইউসি অফিস বা অন্য কোথাও নয়, তাঁর ঠিকানা হতো চিত্ত সুতারের বাড়ি ‘সানি ভিলা’।
(আগামীকাল দ্বিতীয় কিস্তি)