
সিডনির আকাশ সকাল থেকেই মুখ গোমড়া করে ছিল। টিপটিপ বৃষ্টি আর কনকনে ঠান্ডা বাতাস উপেক্ষা করে লাখো মানুষের স্রোত যখন শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে এগোচ্ছিল, তখনই বোঝা যাচ্ছিল, আজকের দিনটি সাধারণ কোনো দিন হবে না। রোববার সিডনির ইতিহাস নতুন করে লেখা হতে চলেছে। ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানাতে এবং গাজায় চলমান মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিবাদে আজ সিডনির আইকনিক হারবার ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে গেল এক অবিস্মরণীয় জনসমুদ্র। আয়োজকদের দাবি, এই মিছিলে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা দুই থেকে তিন লাখ ছাড়িয়েছে, যা এই শহরের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এতে প্রচুর প্রবাসী বাংলাদেশিও অংশগ্রহণ করেছেন।
উত্তপ্ত ছিল পরিস্থিতি
মিছিলটি অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে থেকে এক সপ্তাহ ধরে সিডনিজুড়ে বিরাজ করছিল চরম উত্তেজনা। নিউ সাউথ ওয়েলসের মুখ্যমন্ত্রী ক্রিস মিন্স ও পুলিশ প্রশাসন এই মিছিলের অনুমতি দিতে নারাজ ছিল। তারা নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে মিছিলটি বন্ধ করার জন্য রাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়েছিল। কিন্তু শনিবার আদালত পুলিশের আবেদন খারিজ করে দিয়ে মিছিলের পক্ষে রায় দেয়। এই আইনি লড়াই এবং সরকারের সরাসরি বিরোধিতা সাধারণ মানুষের মধ্যে উল্টো একধরনের জেদ তৈরি করে। আদালতের রায়ের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছিল। সবাই যেন পণ করেছিলেন, সব বাধা উপেক্ষা করে হারবার ব্রিজে তাঁরা যাবেনই।

প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে জনসমুদ্র
বেলা প্রায় দুইটার দিকে নর্থ সিডনি থেকে মিছিল শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই রেলস্টেশনগুলো, বিশেষ করে উইনিয়ার্ড ও নর্থ সিডনি স্টেশন লোকারণ্য হয়ে উঠেছিল। এ সময় ফিলিস্তিনের পতাকা, ব্যানার আর ফেস্টুনে চারপাশ ছেয়ে যায়। কালো, সাদা, সবুজ ও লাল—এই চার রঙে যেন পুরো শহর ঢেকে গিয়েছিল। বাবা-মায়ের হাত ধরে আসা ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে হুইলচেয়ারে বসা বয়োবৃদ্ধ মানুষ, সব বয়স, ধর্ম ও বর্ণের মানুষ এক হয়েছিলেন এক দাবিতে। পুলিশের মতে, অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল ৯০ হাজারের বেশি; কিন্তু আয়োজকদের দাবি, এই সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
এই বিশাল জনস্রোতে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশিও অংশ নেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত, অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া সম্মানে ভূষিত সাবেক সিটি কাউন্সিলর ও সমাজকর্মী সাবরিন ফারুকী। তিনি তাঁর ছেলেকে নিয়ে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এটা এক অভূতপূর্ব আর আবেগঘন দৃশ্য ছিল। সংখ্যা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে, কিন্তু এটা ছিল সত্যিকারের জনসমুদ্র। মানুষ বৃষ্টি উপেক্ষা করে, হুইলচেয়ারে করে এসেছে, বয়স্করা এসেছেন, বাচ্চারা এসেছে। সবচেয়ে বড় কথা, আমার মনে হয়েছে, এই জনস্রোতের ৯০ শতাংশই অমুসলিম। এটি কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের বা জাতির প্রতিবাদ ছিল না, এটা ছিল মানবতার জন্য কান্না। এই দৃশ্য ভোলার নয়।’
বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের স্লোগানের জোরও বাড়ছিল। ‘ফ্রি, ফ্রি প্যালেস্টাইন’, ‘স্টপ দ্য জেনোসাইড’, ‘ইন আওয়ার মিলিয়নস, উই আর অল প্যালেস্টাইনিয়ানস’, স্লোগানে প্রকম্পিত হচ্ছিল হারবার ব্রিজ ও তার আশপাশের এলাকা। যত দূর চোখ যায়, শুধু মানুষ আর মানুষ। মাথার ওপর পুলিশের হেলিকপ্টার চক্কর কাটছে, কিন্তু নিচের জনসমুদ্র তাতে নির্বিকার।
হারবার ব্রিজ এলাকার পরিবেশে একধরনের উৎসবের আমেজ থাকলেও এর পেছনে ছিল গভীর বেদনা আর ক্ষোভের ছাপ। গত মাসে পুলিশের হাতে ও চোখে মারাত্মক আঘাত পাওয়া আন্দোলনকর্মী হান্না থমাসও ছিলেন এই প্রতিবাদ মিছিলে। ফিলিস্তিনি পতাকার রঙের একটি আইপ্যাচ পরে তিনি মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। এ ছাড়া বিশ্বখ্যাত অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও নিউ সাউথ ওয়েলসের দীর্ঘদিনের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বব কারসহ বহু মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব মিছিলে যোগ দেন।

পুলিশের উদ্বেগ ও বিশৃঙ্খলা
আয়োজকদের অনুমানের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মানুষ আসায় পুলিশ একপর্যায়ে দিশাহারা হয়ে পড়ে। নিউ সাউথ ওয়েল পুলিশ সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ‘পরিস্থিতি মাঝেমধ্যে অত্যন্ত উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছিল। আমরা ভিড়ের চাপে মানুষের পিষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছিলাম। আমরা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য ভয় পাচ্ছিলাম।’ তবে বিক্ষোভকারীরা শেষ পর্যন্ত পুলিশের নির্দেশনা অনুসরণ করায় বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।
ঐতিহাসিক মিছিলের পর
বিকেল পাঁচটার কিছু পর হারবার ব্রিজ যান চলাচলের জন্য পুনরায় খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু শহরের কেন্দ্রস্থলে তখনো হাজার হাজার মানুষ। ফিলিস্তিন অ্যাকশন গ্রুপের অন্যতম সংগঠক জশ লিস দিনটিকে ‘ঐতিহাসিক এবং স্মরণীয়’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আজকের দিনটি ছিল গণতন্ত্রের এক বিশাল প্রদর্শনী। লাখ লাখ মানুষ তাঁদের প্রতিবাদের অধিকার প্রয়োগ করেছেন।’
বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় মানুষ যখন ধীরে ধীরে বাড়ির পথ ধরছিলেন, তখনও তাঁদের মুখে ছিল প্রতিবাদের স্লোগান।
কাউসার খান
সিডনি