সাফল্যের রহস্য সামান্য দুর্নীতি, কম অর্থ পাচার ও দক্ষ প্রশাসন

0
149

প্রশ্নটা এসেছিল শ্রোতাদের পক্ষ থেকে। কোরিয়ার উন্নয়নের রহস্য কী? অল্প কথায় উত্তর দিলেন দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক অব কোরিয়ার গভর্নর চ্যাং অং আরহি। বললেন, একটা ভালো শাসনব্যবস্থা তৈরি করতে পারাটাই উন্নয়নের বড় রহস্য। এখানে শুরু থেকেই দুর্নীতি অনেক কম রাখা সম্ভব হয়েছে। দুর্নীতি একদম নেই তা বলা যাবে না, তবে খুবই কম। অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটা ভালো ও কার্যকর সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। ফলে স্থিতিশীলতা বজায় ছিল। আর কখনোই ধনীদের এমন কোনো সুবিধা দেওয়া হয়নি, যাতে তাঁরা অর্থ পাচারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। বরং কোরিয়া শুরু থেকেই অর্থ পাচার বন্ধে সব সময় অত্যন্ত সতর্ক ছিল। ফলে দেশের অর্থ দেশেই বিনিয়োগ হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষার গুণগত মান অর্জনে বিনিয়োগ করা হয়েছে, যার ফল পেয়েছে দেশটি। উন্নয়নের আরেক বড় কারণ হচ্ছে অত্যন্ত দক্ষ একটি জনপ্রশাসন তৈরি করতে পারা। আর সর্বশেষ কারণ হচ্ছে, দেশটির মানুষ সব সময়ই অত্যন্ত পরিশ্রমী। এ জন্য পূর্বপুরুষদের প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানালেন তিনি।

অনুষ্ঠানের অন্যতম আলোচক ইন্দোনেশিয়ার অর্থমন্ত্রী মুলিয়ানি ইন্দ্রাবতী মেনে নিলেন যে উন্নয়নের জন্য সুশাসন হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাশাপাশি একটি ভালো সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি প্রয়োজন, আর দরকার কম দুর্নীতি ও অর্থ পাচার বন্ধ করা, যা অনেক দেশই করতে পারেনি।

উন্নয়নের জন্য সুশাসন হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাশাপাশি একটি ভালো সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি প্রয়োজন আর দরকার কম দুর্নীতি ও অর্থ পাচার বন্ধ করা, মুলিয়ানি ইন্দ্রাবতী, অর্থমন্ত্রী, ইন্দোনেশিয়া

দক্ষিণ কোরিয়ার ইঞ্চনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৫৬তম বার্ষিক সম্মেলন। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন, বুধবারের আয়োজন ছিল ‘গভর্নরস সেমিনার’। অর্থাৎ এডিবির পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের নিয়ে সেমিনার। মূলত সদস্যদেশগুলোর অর্থমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানেরাই এডিবির গভর্নর। এবারের সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘রিবাউন্ডিং এশিয়া: রিকভার, রিকানেক্ট, অ্যান্ড রিফর্ম’। অর্থাৎ এশিয়ার আবার ফিরে আসা: পুনরুদ্ধার, পুনঃসংযোগ এবং সংস্কার। এটিই ছিল সেমিনারের আলোচনার বিষয়। আলোচনায় আরও অংশ নেন ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ, জার্মানির অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়নবিষয়ক পার্লামেন্টারি স্টেট সেক্রেটারি নিয়েলস আন্নেন এবং এডিবির প্রেসিডেন্ট মাসাতসুগু আসাকাওয়া। সেমিনার সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক এবং এসওএএস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের প্রেসিডেন্ট জয়নাব বাদাউই।

প্রয়োজন চার ‘আই’

আলোচনার বিষয় ছিল অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে কী কী প্রয়োজন। এ বিষয়ে ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ জানালেন, কোভিডের সময় থেকেই তাৎক্ষণিক কাজ ছিল খাদ্যনিরাপত্তা বজায় রাখা এবং যারা দুস্থ, তাদের সরাসরি সহায়তা দেওয়া। তবে একই সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি ভাবনা। কেননা, অর্থনীতির পুরোপুরি পুনরুদ্ধার ছাড়া উচ্চ প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়। আবার উচ্চ প্রবৃদ্ধি ছাড়াও পুনরুদ্ধার হবে না। এটা অনেকটা ডিম আগে না মুরগি আগে, সেই বিতর্কের মতো পরিস্থিতি। তবে ভবিষ্যতের জন্য আমাদের অবশ্যই চারটি দিকে খেয়াল রাখতে হবে। সীতারমণের ভাষায় চার ‘আই’। অর্থাৎ এমন চারটি বিষয়, যা লিখতে ইংরেজি আই অক্ষরের প্রয়োজন হয়। যেমন ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা অবকাঠামো, ইনভেস্টমেন্ট বা বিনিয়োগ, উদ্ভাবন বা ইনোভেশন এবং ইনক্লুসিভিটি বা অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা। এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, অবকাঠামো লাগবেই, আর বিনিয়োগ আনতে হবে বেসরকারি খাত থাকে। অর্থনীতির মূলধারায় তরুণদের টেনে এনে উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। নতুন নতুন স্টার্টআপ চালু করার সুযোগ করে দিতে হবে। আর সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করেই উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

‘গভর্নরস সেমিনার’ এ বক্তারা
‘গভর্নরস সেমিনার’ এ বক্তারা

প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার

কোরিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং পদ্ধতি আর এশিয়ার পদ্ধতি ভিন্ন। তার মানে এই না যে চিন্তার কিছু নেই। বরং এখন অনেক বেশি শক্ত নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা ও নজরদারি লাগবে। বিশেষ করে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতের প্রতি মনোযোগ বেশি বাড়াতে হবে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সুদের হার বাড়াচ্ছে। সুতরাং উচ্চ সুদের জগতে টিকে থাকার পরিকল্পনা থাকতে হবে।

ইন্দোনেশিয়ার অর্থমন্ত্রী শ্রী মুলিয়ানি ইন্দ্রাবতী বলেন, বর্তমান সংকট মেটাতে বহুপক্ষীয় সহযোগিতা লাগবে। কোনো এক দেশের পক্ষে এ সমস্যা মেটানো সম্ভব নয়। কেননা, এ সময় সম্পদ যেমন লাগবে, তেমনি প্রয়োজন বিশ্বাস ও আস্থার। বহুপক্ষীয় দাতারাই এসব দিতে পারবে। তাই অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন সংস্কারের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। তিনিও কাঠামোগত সংস্কারের ওপর জোর দেন।

তবে জার্মানির মন্ত্রী নিয়েলস আন্নেন দাতাদের সহায়তার ওপর নির্ভর করে না থাকার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, এখন ছোট–বড় সব দেশই সমস্যায় আছে। এ অবস্থায় দরকার আসলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ।

এডিবির প্রেসিডেন্ট মাসাতসুগু আসাকাওয়া মূলত জলবায়ু পরিবর্তন নিয়েই বেশি কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের কথা বলছি। তবে শিল্পায়নের একটি পরিবেশগত মূল্যও আছে। সুতরাং পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় জলবায়ুর ক্ষতি হবে না, এমন বিনিয়োগ ও বাণিজ্যনীতি গ্রহণ করতে হবে।’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রসিডেন্ট

সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয় দক্ষিণ কোরিয়ার স্থানীয় সময় বেলা আড়াইটায়। তার আগে বেলা ১১টায় অনুষ্ঠিত হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য পুরো সংদো কনভেনসিয়া সেন্টারজুড়ে ছিল বাড়তি নিরাপত্তা। গতকালই প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ার রাস্তায় পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশ দেখা গেল। যদিও এখনকার রাস্তাঘাটে সবাই বেশ সুশৃঙ্খলভাবে চলে, কোথাও কেউ আইন ভাঙেন না।

ভবিষ্যতের জন্য আমাদের অবশ্যই চারটি দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এগুলো হলো ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা অবকাঠামো, ইনভেস্টমেন্ট বা বিনিয়োগ, উদ্ভাবন বা ইনোভেশন এবং ইনক্লুসিভিটি বা অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা

নির্মলা সীতারমণ, অর্থমন্ত্রী, ভারত

আগেই বলা ছিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকতে হলে এডিবির দেওয়া ব্যাজ ছাড়াও অতিরিক্ত হিসেবে পাসপোর্ট দেখাতে হবে। পাসপোর্ট দেখানোর পর আমার রেজিস্ট্রেশনের সময় দেওয়া তথ্যের সঙ্গে সেটা মিলিয়ে দেখে তারপরই দেওয়া হয়েছে আলাদা নিরাপত্তা স্টিকার। সম্মেলন উদ্বোধন করেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট অন সুক ইয়ল। এ সময় আরও বক্তব্য দেন দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত উপপ্রধানমন্ত্রী চু কিয়ং–হো এবং এডিবির প্রেসিডেন্ট মাসাতসুগু আসাকাওয়া।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মূলত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে ভেঙে পড়া সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক করার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বলেন, উৎপাদন খাতে কোরিয়ার রয়েছে বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রযুক্তি এবং চিপ, বায়োটেকনোলজি ও পুনরায় ব্যবহারযোগ্য ব্যাটারি উৎপাদনের সর্বোচ্চ ক্ষমতা। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সরবরাহব্যবস্থা ঠিক করতে তাঁর দেশ এ বিষয়ে সহযোগিতা করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এডিবি যে নতুন ঋণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তাতেও সহযোগিতা করবে কোরিয়া।

জলবায়ু সংকট নিরসনে হবে কে–হাব

গানের জন্য কে–পপ তো এখন বিশ্বজুড়েই পরিচিত নাম। এবার কোরিয়ায় হবে কে–হাব। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত সহায়তা, আলোচনা ও নেটওয়ার্কিংয়ের জন্য এ হাব কাজ করবে। এডিবির উদ্যোগ এটি, হাবটি হবে কোরিয়ায়। এ নিয়ে গতকালই চুক্তি সই করেছেন কোরিয়ার অর্থমন্ত্রী ও এডিবির প্রেসিডেন্ট। ২০২৪ সাল থেকে কে–হাব কাজ শুরু করবে।

তবে গতকাল অন্যতম আকর্ষণ ছিল কোরিয়া কালচারাল নাইট। কোরিয়ার ঐতিহ্যবাহী নাচ ও গান তো ছিলই, আর ছিল জনপ্রিয় কে–পপ গ্রুপ ফরেস্টটেলা ও নিউ জিনের পরিবেশনা। উদ্বোধনের পর এ অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণ ছিল কানায় কানায় ভরপুর। সম্মেলন চলবে আরও দুই দিন।

শওকত হোসেন

ইঞ্চন, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.