লমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের জন্য আরও ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার ছাড় করবে। সংস্থাটি মনে করছে, বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলেও দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উল্লেখযোগ্যভাবে শ্লথ হয়ে পড়েছে। ফলে চলতি অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসবে।
আইএমএফ অবশ্য পূর্বাভাস দিয়েছে যে আগামী অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২৫–২৬ অর্থবছরে অর্থনীতি চাঙা হবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হবে। চলতি বছরে মূল্যস্ফীতি বার্ষিক ভিত্তিতে ১১ শতাংশে থাকলেও আগামী অর্থবছরে তা দ্রুত কমে আসবে। ২০২৫–২৬ অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে দাঁড়াবে বলে সংস্থাটি মনে করছে।
এর আগে আইএমএফ বলেছিল, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হবে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। অক্টোবরে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে এমন প্রাক্কলন করা হয়েছিল। আরও আগে চলতি অর্থবছরের জন্য আইএমএফের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে গত আওয়ামী লীগ সরকার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল।
চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় চতুর্থ কিস্তির অর্থছাড়ের আগে তৃতীয় পর্যালোচনা করতে আইএমএফের ১০ সদস্যের একটি দল ৩–১৮ ডিসেম্বর ঢাকা সফর করে। সংস্থাটির কর্মকর্তা ক্রিস পাপাজর্জিও দলটির নেতৃত্ব দেন। ওই সফরের শেষে আজ বুধবার আইএমএফের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড় করতে সংস্থাটি বাংলাদেশের সঙ্গে কর্মকর্তা পর্যায়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বিষয়টি সংস্থার নির্বাহী বোর্ডে উঠবে।
আইএমএফ জানিয়েছে, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ চলমান ঋণ কর্মসূচির আকার আরও ৭৫ কোটি মার্কিন ডলার বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করেছে। এর ফলে বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ) এবং বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) বাবদ ঋণের আকার দাঁড়াবে ৪০০ কোটি ডলারে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) কর্মসূচির আওতায় ১৩০ কোটি ডলার ঋণ পেয়েছে।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা এর আগে জানিয়েছিলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশ যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হয়েছে, তা মোকাবিলার জন্য অতিরিক্ত অর্থ প্রয়োজন। কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন যে আইএমএফের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৩০০ কোটি ডলার পাওয়া যাবে। চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় অতিরিক্ত অর্থের জন্য বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ যে অনুরোধ করেছে, তা পাওয়া গেলে এই কর্মসূচির আকার দাঁড়াবে ৫৩০ কোটি মার্কিন ডলার।
আইএমএফের সঙ্গে ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। এরপর তিন কিস্তির অর্থ পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পাওয়া যায়। গত ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। আর গত জুনে পেয়েছে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার। তিন কিস্তিতে আইএমএফের কাছ থেকে প্রায় ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ।
আইএমএফের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি এখনো উচ্চপর্যায়ে রয়েছে। দেশ থেকে যে অর্থ বেরিয়ে গেছে, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাত থেকে যে অর্থ বিদেশে চলে গেছে, তা বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি করেছে। পাশাপাশি একদিকে রাজস্ব আদায় কমেছে, অন্যদিকে খরচের চাপ বেড়েছে। বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ আরও জোরদার হয়েছে আর্থিক খাতের ধকলের কারণে।
চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে গণ–আন্দোলন, বন্যা এবং সংকোচনমূলক পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছে আইএমএফ। তবে নীতি শিথিল হলে আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বাড়ার প্রত্যাশা করছে সংস্থাটি। কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণ এবং সরবরাহ–ব্যবস্থায় উন্নতির ফলে মূল্যস্ফীতি কমবে বলে মনে করে আইএমএফ। তবে অর্থনীতিতে গভীর অনিশ্চয়তা আছে বলেও মন্তব্য করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
কর অব্যাহতি অপসারণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের রাশ টেনে ধরা, মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা, বিনিময় হার আরও নমনীয় করা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে কর–রাজস্ব অনুপাত কম। তাই একটি স্বচ্ছ ও ন্যায্য রাজস্ব–ব্যবস্থা গড়ে তুলতে জরুরি ভিত্তিতে রাজস্ব–সংক্রান্ত সংস্কার করতে হবে।
ব্যাংক খাতের দুর্বলতা দূর করার পরমার্শ দিয়ে আইএমএফ বলেছে, দ্রুত যেসব কাজ করতে হবে তার মধ্যে রয়েছে সঠিকভাবে খেলাপিঋণ চিহ্নিত করা, বর্তমানে যেসব নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা রয়েছে তার কার্যকর বাস্তবায়ন এবং আর্থিক খাতে পুনর্গঠনের জন্য একটি রোডম্যাপ বা পথনকশা তৈরি করা। আর্থিক খাতের সংস্কার কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও সুশাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে সংস্থাটি।
এ ছাড়া বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং তৈরি পোশাকশিল্পের বাইরে রপ্তানি খাত আরও বৈচিত্র৵ করতে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের পাশাপাশি সুশাসন বৃদ্ধি করতে পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।