সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার আসামি তানভীর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত সম্প্রতি এ আদেশ দেন।
পুলিশ ও আদালত–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আলোচিত এ হত্যা মামলায় সম্প্রতি তানভীরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার আবেদন করে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। শুনানি নিয়ে আদালত তানভীরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আজিজুল হক আজ বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলা রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য পিবিআই নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যে ৭০ থেকে ৮০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। এই হত্যা মামলার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য তানভীর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’
তানভীরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনে পিবিআই বলেছে, সাংবাদিক মেহেরুন রুনির সঙ্গে তানভীরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তানভীরের সঙ্গে রুনি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন। হত্যাকাণ্ডের আগের দিন ২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বিকেল পাঁচটার দিকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের সামনে তানভীরের সঙ্গে রুনির দেখা হয়। পরে তানভীরের গাড়িতে করে তাঁরা ঘোরাফেরা করেন। এরপর তানভীর সন্ধ্যা সাতটার দিকে রুনিকে তাঁর বাসায় নামিয়ে দেন বলে জানা গেছে। সেদিন রাতে সাগর ও রুনি খুন হন।
পিবিআই আদালতকে বলেছে, সাগর-রুনি খুন হওয়ার সংবাদ পেয়েও তানভীর লাশ দেখতে যাননি। জানাজায়ও অংশ নেননি। এমনকি সাগর ও রুনির কোনো আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করেননি। পিবিআই আদালতকে বলেছে, তানভীরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনের সম্ভাবনা রয়েছে।
এখন পর্যন্ত মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা আজিজুল হক বলেন, ‘আমরা এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
এর আগে এ হত্যা মামলায় সাগর ও রুনি পশ্চিম রাজাবাজারের যে বাসায় ভাড়া থাকতেন, সেই বাসার নিরাপত্তা প্রহরী এনামুল ও পলাশ রুদ্র পালকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পিবিআই।
সাগর-রুনি হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সময় মোট আটজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, আবু সাঈদ, মিন্টু, কামরুল হাসান ওরফে অরুণ, এনামুল, পলাশ রুদ্র পাল ও রুনির কথিত বন্ধু তানভীর রহমান। তাঁদের মধ্যে প্রথম পাঁচজনই মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র হত্যার ঘটনায় র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে তাঁদের সাগর-রুনি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বর্তমানে তানভীর, পলাশ রুদ্র জামিনে মুক্ত আছেন। অন্যদিকে মিন্টু এ মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলেও অন্য মামলায় কারাগারে আছেন।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় এই সাংবাদিক দম্পতি নৃশংসভাবে খুন হন। সাগর মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক ছিলেন। রুনি ছিলেন এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক।
সাগর-রুনি হত্যার ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম বাদী হয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। প্রথমে এ মামলা তদন্ত করছিল শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ। চার দিন পর মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়।
তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ৬২ দিনের মাথায় ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এরপর আদালত র্যাবকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন। তখন থেকে মামলাটির তদন্ত করছিল র্যাব। র্যাবের তদন্তকালে প্রতিবেদন জমার তারিখ পেছায় ১১২ বার। দীর্ঘ সময় পার হলেও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি তারা।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট সাগর-রুনি হত্যা মামলা তদন্তে বিভিন্ন এজেন্সির অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করতে নির্দেশ দেন। এরপর ২৩ অক্টোবর এ মামলার তদন্তে চার সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। টাস্কফোর্স গঠনের পর গত ৪ নভেম্বর র্যাবের কাছ থেকে মামলার নথিপত্র বুঝে নেয় পিবিআই।
২০১৭ সালের ১৫ মার্চ র্যাবের পক্ষ থেকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী এই দম্পতির ছেলে মাহির সরওয়ার মেঘের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আটজনকে।
র্যাব আরও জানিয়েছিল, তখন ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ডিএনএ নমুনা পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের ফরেনসিক ল্যাবে। ডিএনএ প্রতিবেদনে ঘটনাস্থলে অজ্ঞাতপরিচয় দুই পুরুষের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
টাস্কফোর্সের প্রধান ও পিবিআইয়ের প্রধান মো. মোস্তফা কামাল বলেন, খুনের রহস্য উদ্ঘাটন হওয়ার মতো এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দিতে টাস্কফোর্স আদালতের নির্দেশমতো কাজ করছে।