
অন্তর্বর্তী সরকার যদি বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ‘জনতার আদালতে’ আওয়ামী লীগের বিচার করার ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি বলছে, আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করতে পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় জনতার আদালত তৈরি করা হবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার জন্য ফ্যাসিবাদবিরোধী মঞ্চ তৈরি করার আহ্বান জানিয়েছে এনসিপি।
‘গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের বিচার ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের’ দাবিতে আজ শুক্রবার বিকেলে ঢাকায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে এনসিপি। দলের ঢাকা মহানগর শাখার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দেন।
সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, অবিলম্বে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করতে হবে। নৌকা মার্কাকে বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। বিচার চলা পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আইন করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার গত ৯ মাসেও দৃশ্যমান হয়নি বলে অভিযোগ করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, জুলাইয়ের শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল রাষ্ট্রের, সেটিও নিশ্চিত করতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। বিভিন্ন জায়গায় মামলা-বাণিজ্য হচ্ছে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে আওয়ামী লীগ তৃণমূলে পুনর্বাসিত হওয়ার পরিকল্পনা করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘যদি এই সরকার বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে আমরা বসে থাকব না। জনতার আদালতে আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিবাদের বিচার নিশ্চিত করা হবে।’
দ্রুততম সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার জন্য ফ্যাসিবাদবিরোধী মঞ্চ তৈরি করতে নিজ দলের নেতা–কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান নাহিদ। এ সময় তিনি আরও বলেন, পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় জনতার আদালত তৈরি করা হবে।
সমাবেশে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সমালোচনা করে এনসিপির শীর্ষ এই নেতা বলেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সুস্পষ্টভাবে সুপারিশ করেছে, যারা গণহত্যা ও লুটপাট করেছে, যারা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত ছিল, তারা কোনোভাবে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। কিন্তু নির্বাচন কমিশন এখনো সেই প্রস্তাবে সম্মত হচ্ছে না। এই নির্বাচন কমিশন কার স্বার্থ দেখছে, সেই প্রশ্নও তোলেন তিনি।
বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের কারণে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ এখনো আসছে না বলেও অভিযোগ করেন নাহিদ ইসলাম। অবিলম্বে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্রকাঠামো ও শাসনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে মৌলিক সংস্কারের উদ্দেশ্যে জুলাই সনদ কার্যকর করতে হবে। একই সঙ্গে জুলাই সনদে সুস্পষ্টভাবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কথাটি থাকতে হবে।
আইনসভা (সংসদ) এবং গণপরিষদ নির্বাচন একসঙ্গে করার দাবিও তোলেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
আওয়ামী লীগ প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখে নির্বাচন হবে না
আওয়ামী লীগ প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না, হবে না, হবে না—বলে উল্লেখ করেন এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন। তিনি সমাবেশে বলেন, ৫ আগস্ট বাংলাদেশের জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ, নৌকা মার্কা বা মুজিববাদী আদর্শের নামে বাংলাদেশে কোনো রাজনীতি চলতে পারে না। যে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে সন্ত্রাস করেছে, সেই আওয়ামী লীগের নাম নিবন্ধনের (দল হিসেবে ইসিতে নিবন্ধিত থাকা) খাতা থেকে কেটে সন্ত্রাসীদের খাতায় উল্লেখ করতে হবে।
সরকারের উদ্দেশে এনসিপি নেতা আখতার বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের আইনের হাতে তুলে দিন। জনগণের হাতে যদি আওয়ামী লীগ পড়ে, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে আস্ত থাকবে না।’
কোনো যদি কিন্তু নেই
ইসির কলকবজা, কলকাঠি নাড়িয়ে একটি দল নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নামে কোনো দল বাংলাদেশে থাকতে পারবে না। গণপরিষদের মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধান বানাতে না পারলে ১৮ কোটি মানুষের জীবন হুমকির মুখে থাকবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সবাইকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য দেওয়ার আহ্বান জানান এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ রাজনীতি করার সুযোগ পেলে আবারও গণহত্যা সংঘটিত করবে।
কোথাও আওয়ামী লীগের মিছিল দেখলে প্রতিবাদ করা এবং আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের পুলিশে সোপর্দ করার আহ্বান জানান এনসিপির আরেক জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন।
বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের কোনো আলোচনা এই দেশে হবে না বলে উল্লেখ করেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা।
এই সমাবেশ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্দেশে এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা আপনার কাছে কোনো অনুরোধ করছি না, কোনো দাবি করছি না। আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছি, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এর মধ্যে কোনো যদি কিন্তু অথবা নেই।’
এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেন, ‘আমাদের এই লড়াই ও যুদ্ধ তত দিন চলবে, যত দিন এই বাংলাদেশের মাটি থেকে খুনি-সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন না হচ্ছে।’
৫ আগস্ট রায় দেওয়া হয়েছে
এনসিপির এই সমাবেশে মঞ্চের সামনে ছিলেন জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের অনেকে। ছিলেন শহীদ পরিবারের সদস্যরাও।
সমাবেশে প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে রাজনীতি করবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত আপনি বা কোনো রাজনৈতিক দলও নেবে না। সেই সিদ্ধান্ত নেবে শহীদ পরিবার ও আহত পরিবার। আপনাকে আহ্বান করছি, প্রত্যেক শহীদ পরিবারের কাছে যান। তাদের জিজ্ঞেস করুন, তারা আওয়ামী লীগকে চায় কি না।’
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে বিএনপি, জামায়াতসহ প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকে অবস্থান স্পষ্ট করার আহ্বানও জানান হান্নান মাসউদ।
প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা আপনাকে (প্রধান উপদেষ্টা) ক্ষমতায় বসিয়েছে। আপনি কিন্তু এটা বলতে পারেন না যে আওয়ামী লীগ ঠিক করবে আওয়ামী লীগের কী পরিণতি হবে। এটা আওয়ামী লীগ ঠিক করবে না।…বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দল ঠিক করবে আওয়ামী লীগের কী পরিণতি হবে। সেই রায় ৫ আগস্ট আমরা দিয়ে দিয়েছি।’
সমাবেশে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া খালিদ সাইফুল্লাহর বাবা কামরুল হাসান এবং শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বক্তব্য দেন। তাঁরাও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার দাবি জানান।
সমাবেশে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে বক্তব্য দেন তাজনূভা জাবীন, আশরাফ উদ্দীন মাহাদী, আতিক মুজাহিদ, হুমায়রা নূর, মোহাম্মদ আতাউল্লাহ, মাহিন সরকার প্রমুখ। তাঁরা আওয়ামী লীগকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি জানান। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিচার ও সংস্কারের আগে এই দেশে কোনো নির্বাচন হবে না—এমন কথাও উঠে আসে অনেকের বক্তব্যে।