
দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার ইতিবাচক নয়। ডানপন্থার ‘ভূত’ চাপায় এই সরকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিষয়ে কথাবার্তা বলছে না। অতীতের মতোই এই জাতিগোষ্ঠীর ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে। বরং গত এক বছরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী মানুষের ওপর নির্যাতন–নিপীড়ন আরও বেশি করা হচ্ছে।
আদিবাসী ছাত্র, যুব, সাংস্কৃতিক ও প্রগতিশীল সংগঠনসমূহের আয়োজিত প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশে এ কথা বলা হয়েছে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ ও রাজশাহীর তানোরে সাঁওতালদের ওপর নৃশংস হামলা, শেরপুরে গারোদের স্বত্বদখলীয় জমি দখলের ষড়যন্ত্র, সিলেটে খাসিয়াদের পান জুম কর্তন ও উচ্ছেদ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং দীর্ঘদিন মিথ্যা অভিযোগে মামলায় কারাবন্দী নিরীহ নারী, শিশুসহ নিরপরাধ বমদের মুক্তির দাবিতে আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
এ সমাবেশে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সহসাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর নতুন করে পুরোনো ধারার আক্রমণ চলছে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হলে জল, জমি ও জঙ্গলের ওপর তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মানুষের মানবিক মর্যাদা ও অধিকার যখন ক্ষুণ্ন হবে, তখন কেউ নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে না।
ঐকমত্য কমিশন মাসের পর মাস বৈঠক করলেও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে ডাকা হয়নি বলে সমাবেশে উল্লেখ করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দীপায়ন খীসা। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসেও এ সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ‘ডানপন্থার ভূত’ চেপেছে বলেও মন্তব্য করেন দীপায়ন খীসা। তিনি বলেন, ‘ডানপন্থার ভূত চেপেছে বলে এই সরকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিষয়ে কোনো কথাবার্তা বলে না। বম মরলে খবর নেয় না, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো কথা বলে না, ভূমি কমিশন পুনর্গঠন করে না। সরকারের প্রতি বার্তা, ডানপন্থার ভূতকে মাথা থেকে নামিয়ে ফেলেন। জনগণের কথা শুনুন।’
অতীতের মতোই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর প্রতিনিয়তই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের ক্রীড়া, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক উজ্জ্বল আজিম। তিনি বলেন, গত এক বছরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন–নিপীড়ন আরও বেশি করা হচ্ছে।
এই সরকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতি ইতিবাচক নয় অভিযোগ করে উজ্জ্বল আজিম বলেন, সে কারণে আন্দোলন–সংগ্রামের কোনো বিকল্প নেই।
কোনো সরকারের আমলেই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা ভালো ছিল না মন্তব্য করে বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক ফাল্গুনী ত্রিপুরা বলেন, গত এক বছরেও তাঁরা ভালো নেই। অথচ ভালো থাকবেন বলেই তাঁরা জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শরিক হয়েছিলেন।
গাইবান্ধার সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে বলেন, সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) এক নেতা গোবিন্দগঞ্জে ইপিজেডে (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) বাধা দিলে রুখে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন। অর্থাৎ, তিনি সেখানকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে রুখে দেওয়ার কথা বলেছেন। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ যাতে সেচ দিয়ে সেখানে ফসল ফলাতে না পারেন, সে জন্য বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার কথা বলছে প্রশাসন।
সংবিধান পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে। আগের মতো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে সংবিধানের বাইরে রাখা হচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন রাখেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য রিপন চন্দ্র বানাই।
অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সদস্য টুম্পা হাজং। লিখিত বক্তব্যে ছয় দফা দাবি জানানো হয়। সেগুলো হলো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর নৃশংস হামলার সঙ্গে জড়িত ভূমিদস্যু ও সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। মিথ্যা মামলায় দীর্ঘদিন কারাবন্দী নিরীহ নারী-শিশু-শিক্ষার্থীসহ বমদের দ্রুত মুক্তি দিতে হবে। শেরপুরে গারো এবং সিলেটে খাসিয়া জাতিগোষ্ঠীর পান জুম কর্তন, ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদ ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে সংবিধানে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে। সমতল অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভূমি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় এবং ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি আন্তনী রেমা। এ সময় আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহসাধারণ সম্পাদক গজেন্দ্রনাথ মাহাতো, তথ্য ও প্রচার সম্পাদক হিরণ মিত্র চাকমা, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সভাপতি খান আসাদুজ্জামান, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক খোকন সুইটেন মুরমু প্রমুখ। সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহসভাপতি টনি চিরান। আলোচকদের বক্তব্যের মাঝেমাঝে গান পরিবেশন করা হয়।