উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে কমেছে মানুষের সঞ্চয়ক্ষমতা। আবার ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রচুর টাকা চলে গেছে। ঋণ নিয়ে অনেকে ফেরত না দিয়ে নবায়নসহ নানা উপায়ে নিয়মিত দেখানোর প্রবণতায় কমেছে টাকার হাতবদল। এ অবস্থায় তারল্য সংকটে পড়েছে কিছু ব্যাংক। ফলে এখন সরকারের ঋণ চাহিদার বেশিরভাগই দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ৬৬ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে সরকারকে। এর বাইরে ব্যাংকগুলোকেও নিয়মিত ধার দিচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এ ছাড়া ৪৫ হাজার কোটি টাকার চারটি পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, তারল্য সংকটের এ সময়ে এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকের স্বল্পমেয়াদে ধারের সুদ দ্রুত বাড়ছে। গত মঙ্গলবার ১৪ দিন মেয়াদি আন্তঃব্যাংক ধারের সুদহার ১০ শতাংশ পর্যন্ত ওঠে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক মৌখিক নির্দেশনায় ৯ শতাংশের বেশি সুদে আন্তঃব্যাংক লেনদেন করতে মানা করেছে। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বিল ও বন্ডের বিপরীতে সরকারের ঋণের সুদহারও দ্রুত বাড়ছে। মঙ্গলবার সরকার পাঁচ বছর মেয়াদি বন্ডে ঋণ নিয়েছে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ সুদে। আগের দিন যা ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ ছিল।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে যা ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। চলতি মাসে ৯১ দিন মেয়াদি বিলে সুদহার উঠেছে ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশে। গত মাসে যা ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ ছিল। আর ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৪৯ শতাংশ। অন্য সব বিল ও বন্ডের সুদহারও বেড়েছে। এ অবস্থায় সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ার দাবি জোরালো হচ্ছে। যদিও আপাতত সুদহারের সীমা না তোলার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে নতুন করে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিয়েছে ৬৫ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এ সময়ে ঋণ কমেছে ৩৩ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। ফলে প্রথম ছয় মাসে সরকারের নিট ঋণ বেড়েছে ৩২ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা। মূলত বাজারে তারল্য বাড়াতে বাণিজ্যিক ব্যাংকে কমিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ সরবরাহ বাড়ানোর এ কৌশল নিয়েছে। সরকারের ঋণ চাহিদা নিজের ওপর ‘ডিভল্ক্বমেন্ট’ বা চাপিয়ে নিচ্ছে। অবশ্য আগামীতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের হাতে তারল্য বাড়লে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব বিল ও বন্ড বাজারে ছেড়ে দেবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি সরকারকে ঋণ দিলে মূল্যস্ম্ফীতির ওপর চাপ বাড়ে। আবার বেশি সুদ না পেলে আমানত রাখতে নিরুৎসাহিত হন সঞ্চয়কারীরা। এ সময়ে বিভিন্ন কারণে ব্যাংক থেকে অনেকে টাকা তুলে নিয়েছেন। অক্টোবর মাসের তুলনায় নভেম্বরে ব্যাংক খাতের আমানত ৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা কমে ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকায় নেমেছে। আরেকদিকে শুধু গত বছর বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাজারে তারল্য বাড়ানো এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন উভয় সংকটে পড়েছে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা অপরিবর্তিত আছে। ৯ শতাংশের কাছাকাছি মূল্যস্ম্ফীতির এ সময়ে সুদহারের সীমা অপরিবর্তিত থাকায় আমানতের সুদহার বাড়াতে পারছে না ব্যাংকগুলো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনেও সুদহারের সীমা প্রত্যাহার অথবা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়। তবে উচ্চপর্যায় থেকে তাতে সায় মিলছে না। আবার টাকার হাতবদল কমায় অর্থনীতিতেও তার প্রভাব পড়ছে। যে কারণে সিএমএসএমই খাতের জন্য ২৫ হাজার কোটি টাকা, রপ্তানি খাতের জন্য ১০ হাজার কোটি, খাদ্যনিরাপত্তায় ৫ হাজার। কোটি এবং কারখানা সবুজায়নে ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল ঋণে তেমন সাড়া মিলছে না।
ওবায়দুল্লাহ রনি