‘সব ছাপিয়ে গ্রামীণ চরিত্রেই নিজেকে অনন্য করে তুলেছেন ফারুক’

0
142
চিত্রনায়ক ফারুক

গ্রামের প্রতিবাদী যুবক মিলনকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে। বিষক্রিয়ায় মিলনের গলা ফুলে গেছে। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’র শেষভাগে আড়াই মিনিটের একটা শটে মুখের অভিব্যক্তি দিয়ে বিষের যন্ত্রণাকে ক্যামেরার সামনে ফুটিয়ে তুলেছেন ফারুক। দৃশ্যটি বহু দর্শককে কাঁদিয়েছে। চলচ্চিত্র বিশ্লেষক, নির্মাতা মতিন রহমান গতকাল বিকেলে জানান, আড়াই মিনিটের একক শট দেওয়ার মতো শিল্পী বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অভিনয়ের প্রতি নিবেদন, চর্চা, মনোযোগ আর লেগে না থাকলে এটা কোনো শিল্পীর পক্ষে করা সম্ভব নয়।

একের পর এক গ্রামীণ পটভূমির সিনেমায় অভিনয় করে দর্শকের ‘মিয়া ভাই’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। প্রায় পাঁচ দশকের ক্যারিয়ারে গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত ‘নয়নমনি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সারেং বউ’, ‘সুজন সখী’ চলচ্চিত্রে গ্রামের যুবক নয়ন, মিলন, কদম সারেং, সুজনের মতো আলোচিত চরিত্রে প্রাণ দিয়ে গতকাল সোমবার না–ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন ফারুক।

ফারুক একজনই
১৯৭১ সালে এইচ আকবরের ‘জলছবি’ সিনেমা দিয়েই চলচ্চিত্রে ফারুকের অভিষেক। ১৯৭১ সালে অভিষেক হলেও ১৯৭৫ সালে পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন ফারুক, খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘সুজন সখী’ সিনেমায় সুজন চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকমহলে পরিচিতি পান তিনি। সিনেমায় তাঁর বিপরীতে সখী চরিত্রে অভিনয় করেন কবরী। পরের বছর ফারুককে নিয়ে নয়নমনি নির্মাণ করেন আমজাদ হোসেন, সিনেমায় নয়ন নামে এক গ্রাম্য যুবকের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নেন তিনি।

চিত্রনায়ক ফারুক

মতিন রহমানের ভাষ্যে, ‘আমজাদ হোসেন কারও ভাব-ভাষা দেখে বুঝতে পারতেন, তাঁকে কোন চরিত্রে মানাবে। ফারুককে দেখেই তাঁকে গ্রামের তরুণ চরিত্রে আবিষ্কার করেছেন। নয়ন চরিত্রে ফারুককে ভেঙেচুরে তৈরি করেছেন আমজাদ হোসেন।’
কয়েকবার শহুরে তরুণের চরিত্রে পাওয়া গেলে সব ছাপিয়ে গ্রামীণ চরিত্রেই নিজেকে অনন্য করে তুলেছেন ফারুক। গ্রামীণ পটভূমির সিনেমায় তিনি অসামান্য, তাঁকে কেউই ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। আতশ কাচে চোখ রাখলে সমসাময়িক শিল্পীদের তুলনায় ফারুককে সহজেই আলাদা করা যায়।

ফারুক কেন আলাদা
ফারুক কোথায় অনন্য, তার কিছুটা ধারণা দিলেন চলচ্চিত্রের শিক্ষক মতিন রহমান, ‘ফারুক গ্রামীণ মানুষের স্বভাবগত জিদ, তাড়না ও প্রতিবাদের ভাষা দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। তাঁর অভিনয়ের সহজাত ভঙ্গি অন্য শিল্পীদের মধ্যে পাওয়া যায়নি কিংবা তাঁরা সেই ধরনের চরিত্র করেননি। যার কারণে সবার কাছে “মিয়া ভাই” নামে পরিচিত পেয়েছেন তিনি।’

চিত্রনায়ক ফারুক
চিত্রনায়ক ফারুক

ফারুককে নিয়ে ‘মিয়া ভাই’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন চাষী নজরুল ইসলাম। মতিন রহমান বলছেন, ‘মিয়া ভাই নামকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বড় ভাইকে ভাই কিংবা মিয়া ভাই ডাকি। কিন্তু পরিবারের সদস্য না হলেও ফারুককে “মিয়া ভাই” ডাকছি কেন? কারণ, তাঁর আচরণ ভাইয়ের মতো। চরিত্রকে আপন ভাবতেন, নিজের ভঙ্গিতে চরিত্র ধারণ করতেন। এটাই ফারুকের স্বকীয়তা।’
ফারুকের ক্যারিয়ার–সেরা সিনেমাগুলো নির্মিত হয়েছে সত্তর ও আশির দশকে। তখন গ্রামীণ পটভূমির কোনো গল্প ভাবনায় এলেই পরিচালকেরা ফারুককে চাইতেন। ফারুককে নিয়ে ‘লাল কাজল’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেছেন মতিন রহমান। ফারুককে নেওয়ার কারণ কী? নির্মাতা মতিনের ভাষ্যে, ‘শিল্পী নির্বাচনের সময় পরিচালকেরা শিল্পীর আচরণ, বৈশিষ্ট্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। ভাবেন, চরিত্রটি কে ভালো করতে পারবেন, তখন তাঁকে নির্বাচন করা হয়। গ্রামীণ চরিত্র ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন ফারুক, সেই কারণে এই ধরনের চরিত্রে তাঁকে ভাবা হতো।’

সিনেমার গ্রাম ত্যাগ
আশির দশকের শেষভাগ থেকে গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত সিনেমার সংখ্যা কমতে থাকে। সিনেমার গল্পে শহর ঢুকে পড়ে। মতিন রহমান বললেন, ‘তারপর আর সিনেমায় গ্রাম ফিরল না, সিনেমার গ্রামে যাওয়া হলো না।’
মতিন রহমানের ভাষ্যে, ‘ফারুক এক দিনে হননি, তৈরি হতে হতে একটা পর্যায়ে গেছেন। এটা চলচ্চিত্রের পরিবেশ, সিনেমার গল্পের বিষয়, প্রযোজকের ইচ্ছা—সবকিছুর ওপর নির্ভর করে। রিয়াজ, অমিত হাসান, শাকিল খানের মতো জনপ্রিয় নায়কদের গ্রামীণ পটভূমির গল্পে দেখা যায়নি। পরিচালকেরা গ্রামীণ গল্প ভাবেননি, ফলে তাঁদের সুযোগও মেলেনি।’
আক্ষেপ করে মতিন রহমান বললেন, ‘আমরা গ্ল্যামার, চাকচিক্য, অতি নাটকীয়তা খুঁজতে শহরে চলে এসেছি। সেই কারণেই গ্রামীণ পটভূমির সিনেমা দেখা যায় না, গ্রামীণ সিনেমার হিরোও তৈরি হয় না।’

গ্রামে জন্ম, শহরে বেড়ে ওঠা
ফারুকের জন্ম মানিকগঞ্জের ঘিওরের এক গ্রামে। তবে সেখানে বেশি দিন থাকেননি। তিনি বেড়ে উঠেছেন পুরান ঢাকায়। গ্রামের তরুণের সারল্য কীভাবে পেলেন? মতিন রহমান বলছেন, মানুষ যে পরিবেশে বেড়ে ওঠেন, তার ছাপ মানুষের গঠনে থাকে। পুরান ঢাকায় পরিচালক এইচ আকবর, এ টি এম শামসুজ্জামান, প্রবীর মিত্রর মতো নির্মাতা-শিল্পীর সংস্পর্শে এসেছিলেন ফারুক। এ টি এম শামসুজ্জামান, প্রবীর মিত্রদের বেড়ে ওঠা শহরে হলেও গ্রামের সঙ্গে তাঁদের সংযোগ ছিল।

‘নয়নমণি’র একটি দৃশ্যে ববিতা ও ফারুক
‘নয়নমণি’র একটি দৃশ্যে ববিতা ও ফারুক

সেই সময় পুরান ঢাকার লালকুঠিতে নাটক দেখানো হতো, নাটক শেষে নিয়মিত আড্ডা দিতেন শিল্পী, নির্মাতারা; সেখানেই ফারুক নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন। সেখানে নানান অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মিশতেন, সব অঞ্চলের মানুষের ভাব-ভাষা রপ্ত করতেন। পরবর্তী সময়ে তা সিনেমার পর্দায় কাজে লাগিয়েছেন।
অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ২০১৬ সালে আজীবন সম্মাননা ও লাঠিয়াল চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৭৫ সালে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন ফারুক। অভিনয়ের পাশাপাশি রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.