জনমানবহীন ছোট্ট একটি দ্বীপ। শ্রীলঙ্কার অংশ এই দ্বীপ নিয়ে লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে আগে ভারতে তুমুল রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছিল।
শ্রীলঙ্কা ও ভারতকে বিভাজনকারী পক প্রণালিতে অবস্থিত প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপের নাম কচ্ছথিভু। ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রামেশ্বরম শহর থেকে উত্তর-পূর্বে এবং শ্রীলঙ্কার জাফনা শহর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে দ্বীপটির অবস্থান।
দ্বীপটিতে সুপেয় পানির কোনো উৎস নেই। দ্বীপজুড়ে রয়েছে শুধু একটি অবকাঠামো, সেটি হলো একটি গির্জা। প্রতিবছর তিন দিনব্যাপী একটি উৎসব হয় এই গির্জায়। তাতে ভারত ও শ্রীলঙ্কা থেকে পুণ্যার্থীরা অংশ নেন।
কচ্ছথিভুর জলসীমায় মাছ ধরার দাবিতে ১৯২১ সাল থেকে ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। তবে ১৯৭৪ সালে ভারতের এক ঘোষণায় এই বিরোধের অবসান ঘটে। ভারত সরকার জানায়, দ্বীপটির ওপর থেকে সব দাবি প্রত্যাহার করে নিল তারা। এর দুই বছর পর ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে একটি চুক্তি হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী, একে অপরের জলসীমায় দুই দেশের কেউ মাছ ধরা থেকে বিরত থাকবেন।
কিন্তু কয়েক দশক আগের এই সিদ্ধান্ত নতুন করে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। বিতর্কের সূত্রপাত করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ওই চুক্তির সময় ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। এখন তারা বিরোধী দল। নরেন্দ্র মোদির অভিযোগ, ‘নির্বিকার চিত্তে’ দ্বীপটি শ্রীলঙ্কার হাতে তুলে দিয়েছিল কংগ্রেস।
মোদির এমন মন্তব্যের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানায় কংগ্রেস। মোদির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে দলটি বলেছিল, আসন্ন নির্বাচনে মোদি ও তাঁর দল বিজেপির অবস্থান নড়বড়ে। তাই মরিয়া হয়ে যা-তা বলে বেড়াচ্ছেন তিনি।
বিরোধী দলের নেতারা বলছেন, লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফায় ভোট ছিল তামিলনাড়ুতে। রাজ্যটিতে বিজেপির অবস্থান ছিল একেবারে নড়বড়ে। সেখানে ভোটের মাঠে ফায়দা তুলতে কচ্ছথিভুর বিষয়টি সামনে আনার চেষ্টা করেছে বিজেপি। কারণ, বিষয়টি তামিলনাড়ুর মানুষের জন্য বেশ সংবেদনশীল।
কচ্ছথিভু বিতর্কের শুরু হয় লোকসভা ভোটের আগে। এক্সে (সাবেক টুইটার) নরেন্দ্র মোদি এক পোস্টে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক নিবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছিলেন, ‘চোখ খুলে দেওয়ার মতো চমকপ্রদ তথ্য। কংগ্রেস কতটা নির্বিকার চিত্তে কচ্ছথিভু দ্বীপ ছেড়ে দিয়েছিলে, নতুন প্রকাশিত তথ্যে তা–ই জানা যাচ্ছে।’
যেসব নথির ওপর ভিত্তি করে ওই নিবন্ধ তৈরি করা হয়েছিল, সেসব নথি সংগ্রাহক ছিলেন তামিলনাডু রাজ্যের বিজেপির প্রধান কে আন্নমালাই। তথ্য অধিকার আইনে সরকারি দপ্তর থেকে এসব নথি সংগ্রহ করেন তিনি।
নথিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। নেহরু বলছেন, কচ্ছথিভু দ্বীপের কোনো গুরুত্ব তিনি দেখেন না। আর এই কারণে দ্বীপটির ওপর ভারতীয় দাবি প্রত্যাহারে তিনি দ্বিধান্বিত নন।
কিন্তু প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তা ও অন্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কচ্ছথিভু দ্বীপের দাবি-সংক্রান্ত মামলায় ভারতের অবস্থান বেশ ভালো ছিল। তাঁদের দাবি, ১৮৭৫ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত সময়ে অব্যাহতভাবে ও নির্বিরোধে দ্বীপটি শাসন করেন ভারতীয় এক রাজা।
১৯৭৪ সালের ঘটনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন জওহরলাল নেহরুর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর সরকার দ্বীপটি থেকে দাবি প্রত্যাহার করে বিতর্কের অবসান ঘটায়।
এর পর থেকে তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক দলগুলো নিয়মিত কচ্ছথিভু দ্বীপের বিষয়টি তুলে আসছে। শুধু তা-ই নয়, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সম্পাদিত সেই চুক্তি চ্যালেঞ্জ করে আদালতে একাধিক মামলাও হয়েছে। এর মধ্যে দুটি মামলা এখনো ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। কচ্ছথিভুসহ শ্রীলঙ্কার জলসীমায় প্রবেশের কারণে তামিলনাড়ুর মৎস্যজীবীদের গ্রেপ্তার করার খবর মাঝেমধ্যেই শোনা যায়। অর্থাৎ বিষয়টি প্রায়ই ভারতে সংবাদের শিরোনাম হয়ে ওঠে।
নরেন্দ্র মোদির সেই পোস্টের পর বিজেপির অনেক নেতা ও কেন্দ্রীয় একাধিক মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর মতো করে কংগ্রেসের সমালোচনা শুরু করেন। তাঁরা এ-ও দাবি করেন, কচ্ছথিভু দ্বীপ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে যা করা দরকার ছিল, তা করেনি ডিএমকে। তামিলনাড়ুতে বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল ডিএমএকে ১৯৭৪ সালে দ্বীপটির মালিকানা ছাড়ার সময়ও ক্ষমতাসীন ছিল।
তবে ডিএমকে বিজেপির এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, সেই চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার আগপর্যন্ত কচ্ছথিভু দ্বীপের দাবি প্রত্যাহারের বিষয়ে তারা কিছুই জানত না।
ডিএমকের মুখপাত্র সারাভানান আন্নাদুরাই বিবিসিকে বলেন, ‘কচ্ছথিভু দ্বীপের জলসীমায় মাছ ধরার অধিকার নিয়ে গত কয়েক দশকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একাধিক চিঠি দিয়েছে ডিএমকে। এখন এসে বিজেপির বোধোদয় হয়েছে। বিজেপির রাজনৈতিক কারণে কেবল বিষয়টি তুলেছে।’
এমনকি লোকসভা নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও বিষয়টি নিয়ে নরেন্দ্র মোদির সুরেই কথা বলেছেন। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কচ্ছথিভু দ্বীপের বিষয়টি লোকজনের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির অনেক নেতা ও মন্ত্রী বিষয়টি আবার আলোচনা নিয়ে আসায় জয়শঙ্করের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ১৯৭৪ সালের সেই চুক্তি সরকার পুনরায় যাচাই-বাছাই করবে কি না। তিনি উত্তরে বলেছেন, বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন।
২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টকে জানানো হয়, কচ্ছথিভু দ্বীপ শ্রীলঙ্কার কাছ থেকে ভারত ‘পুনরুদ্ধার’ করতে পারবে না। কারণ, এই দ্বীপের কারণে ভারতের কোনো মালিকানাধীন কোনো ভূমি হাতছাড়া হয়নি বা কোথাও ভারতের সার্বভৌমত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়নি। ওই এলাকায় বিতর্কিত এবং কখনো কোনো সীমানা নির্ধারণ করা হয়নি।
পরের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে মোদি সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতাগি আদালতকে বলেন, ‘ভারত কচ্ছথিভু দ্বীপে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়, তাহলে এ জন্য ভারতকে যুদ্ধ করতে হবে।’
বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য জানতে নয়াদিল্লিতে অবস্থিতে শ্রীলঙ্কার দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বিবিসি। তবে দূতাবাস থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
ভারতীয় সংবাদপত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে শ্রীলঙ্কার একজন মন্ত্রী বলেছেন, কচ্ছথিভু দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর দেশের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ করা হয়নি। জীবন থোনদামান নামের ওই লঙ্কান মন্ত্রী বলেন, ‘নিয়ন্ত্রণ রেখা অনুযায়ী কচ্ছথিভু দ্বীপ শ্রীলঙ্কার মধ্যেই পড়েছে।’
এখন দেখার বিষয়, নরেন্দ্র মোদি তৃতীয় মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এখন তিনি এই দ্বীপ নিয়ে নতুন করে কিছু বলেন কি না। নাকি নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে তিনি দ্বীপটি নিয়ে বিতর্ক তুলেছিলেন।