ব্যাংকঋণের ২০% ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে

0
115

দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে থাকা সিএমএসএমই উদ্যোগগুলো এখন অর্থনীতির অন্যতম প্রাণ। তাদের অনেক পণ্য ও সেবা ছাড়িয়েছে দেশের গণ্ডি, উপার্জন করছে বৈদেশিক মুদ্রা—ডলার। বর্তমান সংকটকালে এ আয় অর্থনীতিতে দিচ্ছে ভরসা। তবে আমদানিনির্ভর ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত উদ্যোক্তারা আছেন বিপদে।

আগে এসব উদ্যোক্তার অর্থায়নের বড় মাধ্যম ছিল পরিবার ও স্থানীয় ক্ষুদ্রঋণদাতা সংস্থাগুলো। তবে সময়ের ব্যবধানে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন অর্থায়নের অন্যতম বা বড় মাধ্যম।

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দশম জাতীয় এসএমই পণ্য মেলায় একটি স্টলে গয়না দেখছেন একজন ক্রেতা

গত বছর শেষে কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮২ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ২০ শতাংশের মতো।

আগামী বছরেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের বিতরণ করা মোট ঋণের ২৫ শতাংশ সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ, জাতীয় শিল্পনীতিতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে ব্যাংকঋণের ২৫ শতাংশ দিতে হবে এসএমই খাতে। মূলত এই লক্ষ্য অর্জন করতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন নির্দেশনাটি দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ আগে থেকেই এই খাতের উদ্যোক্তা ও নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে ব্যাংক শাখায় বিশেষ ডেস্ক স্থাপন, কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা, ঋণের আবেদন ও জামানত সহজীকরণ, ঋণসীমা বাড়ানো উল্লেখযোগ্য। এর ফলে ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি উদ্যোক্তারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানমুখী হয়েছেন, চড়া সুদের পরিবর্তে কম সুদে ঋণ পেয়ে ব্যবসা করতে পারছেন।

করোনার প্রকোপ শুরু হলে ২০২০ সালের এপ্রিলে সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করে সরকার। এসব ঋণে গ্রাহকদের সুদ দিতে হয় ৪ শতাংশ। এই খাতের উদ্যোক্তাদের বড় অংশ আগে থেকেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকায় সহজেই তাঁদের চিহ্নিত করা ও ঋণ দেওয়া সম্ভব হয়।

প্রণোদনা ও বিভিন্ন তহবিলের ফলে এই খাতে ঋণের সুদহার এখন ৪ থেকে ৭ শতাংশ। তবে সাধারণ এসএমই ঋণে সুদহার আগামী মাস থেকে বাড়ছে। বর্তমানে এই খাতের ঋণের হার ৯ শতাংশ হলেও জুলাই থেকে তা হবে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এই খাতে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিচ্ছে আইডিএলসি ফাইন্যান্স। এই খাতে প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৩৮ শতাংশ। প্রচলিত ব্যবসার বাইরে বৈচিত্র্যময় ব্যবসায় সঙ্গে যুক্ত উদ্যোক্তারা পাচ্ছেন আইডিএলসির এ ঋণ।

আইডিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম জামাল উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃ অর্থায়ন তহবিলের আওতায় উদ্যোক্তারা কম সুদে ঋণ পাচ্ছেন। এসব ঋণের চাহিদাও অনেক। এসএমই খাতের যেসব উদ্যোক্তা করোনার সময় খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হননি, তাঁরা ভালো করছেন। আবার যাঁরা করোনার পর ব্যবসা শুরু করেছেন, তাঁরাও ভালো করছেন। তাই এসব ঋণ আদায় নিয়মিত আছে। যাঁরা করোনার ধাক্কা খেয়েছেন, তাঁদের ঘুরে দাঁড়াতে একটু সময় লাগছে।

সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তারা যেমন উৎপাদন খাতের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, তেমনি বড় একটি অংশ যুক্ত ট্রেডিং তথা আমদানি ব্যবসার সঙ্গে। এ জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণ করা ঋণের বড় অংশই যাচ্ছে ব্যবসা খাতে। ২০২২ সালে সিএমএসএমই ঋণের প্রায় ৪৪ শতাংশই বিতরণ হয়েছে ব্যবসা উপখাতে। শিল্প ও সেবা উপখাতে গত বছর ঋণ গেছে যথাক্রমে সাড়ে ৩৭ শতাংশ ও ১৮ শতাংশ। গত বছর নারী উদ্যোক্তারা পেয়েছেন ৫ শতাংশের কম ঋণ।

ব্র্যাক ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবদুল মোমেন বলেন, ‘আমাদের ঋণের ৫৩ শতাংশই এসএমই খাতে। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে এ খাতে ২৬ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধির আশা করছি। এই ঋণের চাহিদা আছে, বিতরণও ভালো হচ্ছে। আবার আদায়ও ভালো। ঋণপত্র খুলতে কিছুটা সমস্যা ও খরচ বাড়লেও এসএমই উদ্যোক্তারা ভালো করছেন।’

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সিএমএসএমইর অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা উপখাতে ঋণ বিতরণ নিরুৎসাহিত করতে সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও প্রতিবছরই এ খাতে সীমার বেশি ঋণ বিতরণ করছে ব্যাংকগুলো।

এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করে বলেছে, ২০২৪ সালে সিএমএসএমই খাতে যে ঋণ বিতরণ করা হবে, তার ৫০ শতাংশ দিতে হবে কুটির, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র উদ্যোগে। আর নারী উদ্যোগে দিতে হবে ১৫ শতাংশ ঋণ। সিএমএসএমই খাতে মোট যে ঋণ দেওয়া হবে, তার মধ্যে ৪০ শতাংশ যাবে উৎপাদনশীল খাতে, সেবা খাতে ২৫ শতাংশ ও ব্যবসা খাতে ৩৫ শতাংশ।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এসএমই বিভাগের প্রধান সঞ্জীব কুমার দে বলেন, ‘করোনা মহামারি ও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি কিছুটা হলেও বিপর্যস্ত। এসএমই ব্যবসায়ীরাও তাঁর ব্যতিক্রম নন। করোনার সময় সরকারের কম সুদে ঋণের উদ্যোগও বেশ কার্যকর ছিল।

তবে আমদানিনির্ভর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো চাহিদামতো ঋণপত্রে খুলতে না পারায় কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত। অনেক ছোট ছোট ব্যবসা বন্ধ হয়েছে, অনেকে তাদের দেনাদারদের কাছ থেকে সময়মতো টাকা আদায় করতে হিমশিম খাচ্ছে। যার প্রভাব ব্যাংকিং খাতেও পড়েছে।’

গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এই খাতে প্রাইম ব্যাংকের ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা। প্রাইম ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজিম এ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের ব্যাংকের এসএমই ঋণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। উদ্যোক্তারাও ভালো করছেন। এই সময়ে ঋণ আদায়ে তেমন কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.