আমাজনে ৪০ দিন: কাসাভার ময়দা, ফল খেয়ে বেঁচে ছিল চার শিশু

0
115
আমাজন জঙ্গলে ৪০ দিন কাটানো চার শিশুর মধ্যে সবচেয়ে ছোট শিশুর বয়স ১১ মাস, ছবি: এএফপি

উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে এক মাসের বেশি সময় আমাজন জঙ্গলে কাটানো চার শিশু মূলত কাসাভার ময়দা খেয়ে বেঁচে ছিল। ওই ময়দা যখন শেষ হয়ে যায় তখন তারা জঙ্গলের ভেতরে ফলমূল সংগ্রহ করে খেয়ে টিকে ছিল। কলম্বিয়ার সেনাবাহিনী ও শিশুদের স্বজনেরা এ তথ্য জানিয়েছেন।

কলম্বিয়া সেনাবাহিনীর মুখপাত্র সানচেজ সুয়ারেজ সাংবাদিকদের বলেছেন, শিশুরা তিন কেজি ‘ফারিনা’ খেয়ে ছিল। ফারিনা হলো কাসাভার ময়দার একটি ধরন, যেটা ততটা মসৃণ নয়। এই খাবার আমাজন অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো খেয়ে থাকে।

সেনাবাহিনীর ওই মুখপাত্র বলেন, উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার পর বেশ কিছুদিন শিশুরা তাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ওই খাবার খেয়ে থাকে। যখন খাবার ফুরিয়ে আসে তখন তারা এমন জায়গার খোঁজ করতে থাকে, যেখানে তারা টিকে থাকতে পারবে।

গত ১ মে মায়ের সঙ্গে উড়োজাহাজে করে আমাজন অঞ্চলের আরারাকুয়ারা গ্রাম থেকে সান হোসে ডেল গুয়াভিয়ারে যাচ্ছিল ওই চার শিশু। সিসনা একক ইঞ্জিনের ছোট ওই উড়োজাহাজে চার শিশুর সঙ্গে মোট তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ছিলেন। ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় পাইলট জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। কিছুক্ষণ পর সেটি রাডার থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় শিশুদের মা মাগডালেনা মুকুতুই ভ্যালেন্সিয়া, পাইলট হারনান্দো মুরসিয়া মোরালেস ও একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নেতা হারমান মেনদেজা হারনান্দেজ মারা যান। এতে শিশুরা গভীর জঙ্গলের মধ্যে একা হয়ে পড়ে। হুইতোতো জনগোষ্ঠীর ওই চার শিশুর বয়স যথাক্রমে ১৩, ৯, ৪ বছর এবং অপরজন ১১ মাসের নবজাতক।

দুর্ঘটনার পর থেকেই উড়োজাহাজের যাত্রীদের সন্ধানে তল্লাশি শুরু হয়। শুক্রবার দুর্ঘটনাস্থলের ৫ কিলোমিটারের মধ্যের একটি জায়গা থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে তারা কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটার একটি হাসপাতালে ভর্তি। শনিবার ওই হাসপাতালে গিয়ে শিশুদের স্বজনদের পাশাপাশি কলম্বিয়ার সরকারি কর্মকর্তা এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন।

ওই হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে শিশুদের চাচা ফিদেনসিও ভ্যালেন্সিয়া সাংবাদিকদের বলেন, উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর তারা সেটির ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে ফারিনা বের করে নেয়। সেগুলো খেয়ে তারা টিকে থাকে। ফারিনা শেষ হয়ে গেলে তারা বনের ফলমূল কুড়িয়ে খেতে থাকে।

কাসাভা মূলত একধরনের শিকড়জাত আলু। এটি পাহাড়ি, অনাবাদি এবং অপেক্ষাকৃত কম উর্বর জমিতে চাষ হয়। বাংলাদেশে এটা ‘শিমুল আলু’ নামেও পরিচিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে এর চাষ বেড়েছে।

কলম্বিয়া সেনাবাহিনীর মুখপাত্র সানচেজ সুয়ারেজ বলেন, তাঁরা যখন জঙ্গলের মধ্যে চার শিশুকে খুঁজে পান, তখন তাদের চেহারায় অপুষ্টির ছাপ ছিল। তবে তাদের জ্ঞান ছিল এবং তারা স্পষ্ট কথা বলতে পারছিল। তিনি বলেন, ‘আদিবাসী পরিবারের হওয়ার কারণে তাদের দেহে এমনিতেই বনকেন্দ্রিক কিছু রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে ছিল। তা ছাড়া জঙ্গলের ভেতর কী খাওয়া যাবে আর কী খাওয়া যাবে না, এমন বেশ কিছু বিষয়ে তাদের ধারণা ছিল। এ ছাড়া পানি পাওয়ার কারণে তারা টিকে থাকতে পেরেছে। তারা এসব বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত না থাকলে এ রকম বৈরী পরিবেশে টিকে থাকতে পারত না।’

সেনা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শিশুদের উদ্ধারের পর শনিবার এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের বোগোটার ওই হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে শিশুদের দেখে আসার পর কলম্বিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইভান ভ্যালেসকুয়েজ সাংবাদিকদের বলেছেন, তাদের শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিয়েছে। এখনো তারা কিছু খেতে পারছে না। তবে তারা ভালো আছে এবং এখন বিপদমুক্ত।

এই শিশুদের খোঁজে আমাজনে ব্যাপক তল্লাশি চালানো হয়েছিল। কলম্বিয়া বিশেষ বাহিনীর শতাধিক সদস্য ছাড়াও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ৭০ জন স্কাউট সদস্য গভীর জঙ্গলে তল্লাশি চালাতে থাকেন। শিশুরা কর্মকর্তাদের বলেছে, এর মধ্যে তারা তল্লাশি কাজে ব্যবহৃত একটি কুকুরের দেখা পেয়েছিল। সেটি ছিল বেলজিয়ান শেফার্ড। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র সানচেজ সুয়ারেজ জানান, বিশেষ বাহিনীর ওই কুকুর গত ১৮ মে নিখোঁজ হয়েছিল। ‘শিশুরা আমাদের বলেছে, তারা উইলসন নামের কুকুরটির সঙ্গে তিন–চার দিন ছিল। তারা কুকুরটিকে শারীরিকভাবে খুব দুর্বল অবস্থায় পেয়েছিল,’ বলেন তিনি।

তল্লাশিতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলে যাওয়ায় এই শিশুদের খুঁজে পাওয়ার আশা ফিকে হয়ে এসেছিল। সেখানে তাঁদের এভাবে ফিরে আসা কলম্বিয়ার জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো গতকাল হাসপাতালে গিয়ে শিশুদের দেখে এসেছেন। তিনি বলেছেন, আমাজনের জঙ্গেলে তাদের বেঁচে থাকা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

‘তারা ছিল জঙ্গলের শিশু। এখন তারা কলম্বিয়ার শিশু,’ বলেছেন প্রেসিডেন্ট।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.