শীর্ষ চরমপন্থী নেতা শিমুল ভূঁইয়াই আমানুল্লাহ

0
61
শিমুল ভূঁইয়া
সম্প্রতি চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে খুন হন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন সৈয়দ আমানুল্লাহ। যার আসল নাম শিমুল ভূঁইয়া। তিনি মূলত সংসদ সদস্য আনার হত্যাকাণ্ডের মূল সংঘটক। যিনি পাসপোর্টে শিমুল নাম বদলে আমানুল্লাহ নামে কলকাতা যান।
 
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রও পরে নিশ্চিত করেছে যে শিমুল ভূঁইয়াই নিজের নাম সৈয়দ আমানুল্লাহ বলে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি আমানুল্লাহ নামেই পাসপোর্ট বানিয়েছেন, সেই পাসপোর্টে তিনি কলকাতায় গিয়েছিলেন। ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকা থেকে পাসপোর্টটি করা হয়েছিল। পাসপোর্ট করতে একই নামে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্রও (এনআইডি) তৈরি করিয়েছেন। কীভাবে তিনি শিমুল ভূঁইয়া থেকে আমানুল্লাহ হলেন এবং ভুয়া পাসপোর্ট ও এনআইডি তৈরি করলেন, এখন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন গোয়েন্দারা।
 
কে এই শিমুল ভূঁইয়া?
 
খুলনার অপরাধ জগতের সম্রাট খ্যাত শিমুল ভূঁইয়া এলাকাবাসীর কাছে এক আতঙ্কের নাম। এখনো তার নামে ওই অঞ্চলে চলে অন্ধকার দুনিয়ার সব কায়কারবার। তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন বর্তমানে খুলনা জেলা পরিষদের সদস্য আর ভাই শরীফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া ওরফে শিপলু ভূঁইয়া ফুলতলা উপজেলার দামোদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। খুলনার এই ভূঁইয়া পরিবারের খুনের ইতিহাসও বেশ দীর্ঘ।
 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ চরমপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল-জনযুদ্ধ) অন্যতম শীর্ষ নেতা। ভাই শিপলু ভূঁইয়া ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ার পর শিমুলের পাসপোর্টে বসিয়ে দেওয়া হয় আমানুল্লাহ নামটি। আমানুল্লাহ নামের পাসপোর্ট ব্যবহার করেই তিনি ভারতে যাওয়া-আসা করতেন।
 
এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শিমুল ছাড়াও তার পরিবারের আরও তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারা হলেন- শিমুলের স্ত্রী সাবিনা মুক্তা, বড় ভাই লাকি ভূঁইয়া ও ভাতিজা তানভীর ভূঁইয়া।
 
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, কলকাতার নিউ টাউনের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে সংসদ সদস্যকে খুন করে ১৫ মে দেশে ফেরেন আমানুল্লাহ পরিচয় দেওয়া শিমুল ভূঁইয়া। পরে ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি বাসা থেকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেন যে আনোয়ারুল আজিম আনারকে তারাই নৃশংসভাবে খুন করেছেন।
 
এই খুনের জন্য সংসদ সদস্য আনারের বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীনের সঙ্গে চুক্তি হয়। আনারের সঙ্গে শাহীনের সোনা চোরাচালান ও হুন্ডির ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথ্য পাচ্ছে।
 
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমকে খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সৈয়দ আমানুল্লাহ নামে পরিচয় দানকারী শিমুল ভূঁইয়া। তার গ্রামের বাড়ি খুলনার ফুলতলার দামোদর ইউনিয়নে। তিনি খুলনা অঞ্চলে চরমপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতা ছিলেন।
 
সূত্র বলছে, শিমুল ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে খুনসহ অন্তত দুই ডজন মামলা আছে। গণেশ নামের এক ব্যক্তিকে খুন করে যশোরের অভয়নগর থানার এক মামলায় তিনি সাত বছর (১৯৯১-৯৭) জেল খাটেন। ইমান আলী নামের এক ব্যক্তিকে খুনের ঘটনায় ২০০০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত জেল খাটেন।
 
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, এমপি আনার হত্যায় মূল মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামান শাহীন। শাহীনের সঙ্গে কলকাতায় ছিলেন গার্লফ্রেন্ড শিলাস্তি রহমানও। এই ঘটনায় মূল হত্যাকারী বা সংঘটক হলেন আমানুল্লাহ। তার আসল নাম কিন্তু আমানুল্লাহ না। তিনি মিথ্যে নামে পাসপোর্টটি করেছেন। তার আসল নাম শিমুল ভূঁইয়া। যিনি পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির বড় নেতা ছিলেন। তার নামে অনেকগুলো হত্যা মামলা রয়েছে। আনার হত্যার ঘটনাটি আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি।
 
ঢাকা ও কলকাতার পুলিশ জানিয়েছে, ১৩ মে কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেনসের একটি ফ্ল্যাটে হত্যা করা হয় আনোয়ারুল আজিমকে। তার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় ১৮ মে কলকাতার বরাহনগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছিল।
 
তদন্ত করতে গিয়েই প্রথম কলকাতার পুলিশ তথ্য পায়, ওই ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিল আখতারুজ্জামান শাহীন। আর সেই ফ্ল্যাটে অন্যদের সঙ্গে ছিল সৈয়দ আমানুল্লাহ (শিমুল ভূঁইয়া) ও শিলাস্তি রহমান।
 
এ তথ্যের সূত্র ধরে এই দুজনকে আটক করে ডিবি। পরে ফয়সাল আলী ওরফে সাজি নামে আরও এক ব্যক্তিকে আটক করে।
 
হারুন অর রশীদ বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকায় বসে ২/৩ মাস আগে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। ঢাকায় না পেরে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে কৌশলে নেওয়া হয় কলকাতায়। সেখানে তাকে হত্যার পর শরীর টুকরো টুকরো করে হাড্ডি থেকে মাংস আলাদা করা হয়। এরপর হলুদ মিশিয়ে ব্যাগে ভরে ওই বাসা থেকে বের করা হয়েছে। তবে কোথায় মরদেহের খণ্ডিত অংশ ফেলা হয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
 
হারুন অর রশীদ বলেন, অপরাধীরা বিদেশের মাটিতে অপরাধ করলে বাংলাদেশ পুলিশের নজরে আসবে না বলেই কলকাতা বেছে নেয়। বাংলাদেশের মাটিতে অপরাধ করার সাহস পায়নি। তবে তারা এ হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে থাকতে পারেনি। আমরা তিনজকে গ্রেপ্তার করেছি। আরও কয়েকজনকে নজরাদিতে রাখা হয়েছে।
 
তিনি বলেন, আনারকে হত্যার নেপথ্যে রাজনীতি বা অর্থনৈতিক যে কারণেই থাকুক না কেন বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা কলকাতায় গত ২৫ তারিখ একটি বাসা ভাড়া নেয়। তারা ৩০ এপ্রিল ওই বাসায় ওঠে। যিনি হত্যার পরিকল্পনা করেছেন তিনিও আরেকজনসহ মোট তিনজন বিমানে করে কলকাতার ভাড়া বাসায় ওঠেন।
 
তারা দুই মাস ধরে খেয়াল রাখছে কখন আনারকে কলকাতায় আনা যাবো। সেখানে আরও দুজনকে হায়ার করা হয়। তারা ওই বাসায় আসা যাওয়া করবে। তারা হলেন, জিহাদ বা জাহিদ ও সিয়াম। মাস্টারমাইন্ড গাড়ি ঠিক করে। কাকে কত টাকা দিতে হবে। কারা কারা হত্যায় থাকবে, কার দায়িত্ব কী হবে। কিছু কাজ আছে বলে ৫-৬ জন রেখে ১০ মে বাংলাদেশে চলে আসেন আখতারুজ্জামান শাহীন।
 
গত ১২ মে আনার তার ভারতীয় বন্ধু গোপালের বাসায় যায়। ১৩ তারিখ ওই ভাড়া বাসায় ওঠেন। ফয়সাল নামে একজন তাকে রিসিভ করেন। সেখান থেকে নিয়ে যিনি মূল হত্যাকারী তিনি আনার ও ফয়সালকে নিয়ে চালক রাজার গাড়িতে করে ওই বাসায় যায়। আগে থেকে অবস্থান করা মোস্তাফিজও বাসায় ঢোকেন। আগে সেখানে ভেতরে ছিল জাহিদ, সিয়াম। আধা ঘণ্টার মধ্যে নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
 
তাদের পরিকল্পনা ছিল, বিদেশের মাটিতে হত্যার কাজটি সংঘটিত করবে। হত্যার পর তার লাশ এমনভাবে গুম করে দেওয়া হবে যাতে করে কেউ কোনদিন খুঁজে না পায়। হত্যার পর তার শরীর বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। হাড়-হাড্ডি থেকে শরীরের মাংস আলাদা করা হয়েছে। এরপর গ্রে কালারের লাগেজ ভরে মূল হত্যাকারী যিনি আমাদের কাছে আছেন তিনি, জাহিদ ব্রিফকেস নিয়ে বের হয়। এরপর সিয়াম পাবলিক টয়লেটের কাছে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। সেখানে গিয়ে অবস্থান নেয়। সেখানে আসেন আরেকজন তিনি আমানুল্লাহ। ভারতীয় চালকসহ তারা গাড়ি নিয়ে চলে যায়।
 
মূল যে হত্যাকারী তিনি বাসায় চলে যান। পরবর্তী সময়ে ২/৩ জন মিলে আনারের খণ্ড বিখণ্ড শরীর কয়েকটি ব্যাগে ভরে নিয়ে যায়। তারা এমন নৃশংস কায়দায় হত্যার কাজটি সংঘটিত করেছে যাতে করে ধরা না পড়ে। সেজন্য তারা হাড়গোড় মাংস আলাদা করেন, হলুদ মিশিয়ে দেন। যাতে করে কেউ বললেও বলতে পারে বাজার থেকে আনা। উদ্দেশ্য একটাই ছিল যে, কেউ যেন কোনো দিন আনারের অস্তিত্ব খুঁজে না পায়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.