শাসিতের সম্মতি ছাড়া গণতন্ত্র চলে না

0
133
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ রণজিৎ গুহ (জন্ম: ২৩ মে ১৯২৩, মৃত্যু: ২৮ এপ্রিল ২০২৩)

খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ও নিম্নবর্গের ইতিহাসের তাত্ত্বিক রণজিৎ গুহ গত ২৮ এপ্রিল প্রয়াত হয়েছেন। জীবনের শেষ পর্বে নিজেকে তিনি সমর্পণ করেছিলেন সমাজ, রাজনীতি, দর্শন আর সাহিত্যের ভাবনায়। সরকার ও জনতার সম্পর্ক নিয়ে এই রচনা যেকোনো গণতন্ত্রেই প্রাসঙ্গিক

প্রতিবাদ মনুষ্যত্বের ধর্ম। এ দিক থেকেই জীবজগতে মানুষের অনন্যতা, সে কেঁচো নয়, মেরুদণ্ড সোজা করে সে প্রতিবাদ করতে জানে। ঘোর স্বৈরাচারী সমাজেও প্রতিবাদ নীরব হয়ে থাকে না। যেমন, আমাদের পল্লিগাথা, পল্লিগীতি ও মঙ্গলকাব্যে পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে নারী-কণ্ঠের প্রতিবাদ বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির বহুমূল্য সম্পদ বলে গণ্য হয়।

বস্তুত, প্রতিবাদী ভূমিকাতেই মানুষ যুগে যুগে ইতিহাসের নায়ক হয়ে ওঠে; বিশেষ করে যখন একই যুগের এক পর্ব থেকে পর্বান্তরে পালাবদল হয়। যে শাসিত এত দিন বশ্যতা স্বীকার করে সমাজের ভার বহন করছিল, সে-ই তখন মাথা তুলে দাঁড়ায়, প্রভুশক্তি বিপন্ন বোধ করে।

শাসকদের অভিধানে সেই বিপন্ন মুহূর্তগুলির পরিচয় পাওয়া যায় বিপ্লব, বিদ্রোহ, অরাজকতা, শান্তিভঙ্গ, বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি নামে। কিন্তু যে নামেই হোক, তীব্রতা ও বিস্তারের মাত্রা অনুযায়ী নামগুলিতে শাসনকর্তাদের অস্বস্তি ও উৎকণ্ঠাই ব্যক্ত হয়। ওই সব নামের পরিভাষায় তারা যেন বলছে—হায় হায়, আইন অমান্য করা হল, যে আইন ছাড়া সমাজের সংহতি রক্ষা করা যায় না, সেই আইন ভাঙা হচ্ছে। তাদের দিক থেকে কথাটায় ভুল নেই। আইন ছাড়া শাসন চলবে কী করে? কিন্তু প্রতিবাদীর পক্ষেও তো অন্যায় আইন মেনে নেওয়া শক্ত। মেনে নিলে তার নিজের মনুষ্যত্ব নিজের কাছেই অপমানিত হবে।

এই উভয়সংকটের সমাধান স্বৈরতন্ত্রে বেশ সহজ। কেননা, তার ভিত্তি বাহুবলে। তাই নির্দ্বিধায় হিংসার হাতিয়ারগুলি দিয়ে আইনের মান্যতা বজায় রাখা সম্ভব। বস্তুত, বাহুবলই যে আইনের উৎস, সে সত্য স্বৈরতন্ত্রী শাসকরা গোপন রাখার চেষ্টা করেন না। বরং তার দ্বারা শাসিতের মনে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা প্রশাসনিক কর্তব্য বলেই গণ্য হয়ে থাকে।

কখনও কখনও জনমতের আদালতে সমগ্র সরকার ও শাসক দলকেই অভিযুক্তের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে, যদি নাগরিক অধিকার সম্পর্কে তাদের অবজ্ঞা ও অবহেলা শাসিতদের কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে

রাজনীতিতেও বাহুবলই ক্ষমতার চরম নির্ণায়ক। তবে গণতন্ত্রে তার প্রয়োগ শাসিতের সম্মতি-সাপেক্ষ। এখানেই স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে এর মূলগত পার্থক্য। সে জন্যই আইন কী হবে এবং কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা নিয়ে রাজনীতিতে নানা মতের ও নানা পথের এত জটিলতা।

প্রতিবাদের মর্যাদা

সে জটিলতার কেন্দ্রীয় সমস্যা ভারসাম্যের। সম্মতি ও প্রতিবাদের এক পাল্লা যাতে অন্যটার চেয়ে বেশি ভারী হয়ে না পড়ে, সে বিষয়ে গণতন্ত্রের হুঁশিয়ারিতে ঢিলেমি অমার্জনীয়। ব্রিটেন ও ভারতের মতো পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রে তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসক দলকে সতর্ক থাকতে হয়, যাতে গণভোটে নির্বাচিত কোনও প্রতিষ্ঠানে বিরোধী পক্ষের সম্মান ক্ষুণ্ন না হয়। এর জন্য অনেক প্রতীকী বিধিব্যবস্থাও আছে। আনুষ্ঠানিকভাবে সেগুলি মেনে না চললে শাসকগোষ্ঠীই জনসাধারণের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হয়। এ থেকেই বোঝা যায় যে, আইনসম্মত প্রতিবাদ গণতন্ত্রে অশ্রদ্ধেয় নয়। তাদের সম্পর্ক বৈরিতার নয়, আনুকূল্যের। কারণ, সংসদীয় আদর্শে শাসক ও বিরোধী উভয় দলই নাগরিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি। সুতরাং, নির্বাচকদের ভালমন্দ দু’পক্ষেরই দায়িত্ব, এবং সে দায়িত্বে তারা একে অন্যের পরিপূরক।

কিন্তু তাই বলে কি গণতন্ত্রে প্রতিবাদকে এতটা মূল্য দেওয়া উচিত? নিশ্চয়ই উচিত। কারণ, প্রতিবাদের অভাবে গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে, এমনকি রুগ্ণ বা মুমূর্ষু অবস্থায় তা শেষ পর্যন্ত স্বৈরতন্ত্রেরই কুক্ষিগত হতে পারে। তাই প্রতিবাদের কাজই হল শাসনব্যবস্থার দোষত্রুটির প্রতি শাসক দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, গণতান্ত্রিক আদর্শ থেকে বিচ্যুতিগুলি আইনসভায় ও তার বাইরে জনমতের কাছে পেশ করা, আবেদন-নিবেদন থেকে শুরু করে সব রকমের বৈধ উপায়ে গণতন্ত্রেরই স্বার্থে নাগরিক অধিকার সম্পর্কে নির্বাচকদের শিক্ষিত করা ও সজাগ রাখা।

প্রতিবাদীর আত্মশক্তি
ক্ষমতার গদিতে কে বসেছে বা বসেনি, তার খতিয়ানই প্রতিবাদের মূল্য সম্পর্কে শেষ কথা নয়। প্রতিবাদের ভিত্তি প্রতিবাদীর আত্মশক্তিতে। প্রতিবাদ যদি ন্যায়সংগত হয়, যে-কোনও হিসেবেই তা জমা পড়বে লাভের কোটায়।

প্রতিবাদের গুরুত্ব ও যৌক্তিকতা মেনে নিয়েও কেউ হয়তো প্রশ্ন করবেন, প্রতিবাদটা ঠিক কার বিরুদ্ধে। যদি বলা হয় সরকারের বিরুদ্ধে, তা হলেও খটকা থেকে যায়। সরকার বলতে যা বোঝায়, তা আসলে তো রাষ্ট্রশাসনের জন্য তৈরি চাকার মধ্যে চাকায় নানা দফতরের নানান ভাগে-উপভাগে হাজার হাজার আমলার মর্জি ও মেজাজে দম-দেওয়া সহস্রবাহু যন্ত্রের মতো। যে হাতটা অন্যায় করেছে, কেবল তারই বিরুদ্ধে নালিশ করে সে মেশিনটার কাছ থেকে যখন বিচার পাওয়া যায় না, এমনকি সাড়াও পাওয়া যায় না, তখন নাগরিকরা যাবে কোথায়?

প্রতিবাদ আর প্রতিকার

অনেকেরই কাছে তাই সরকার তথা রাষ্ট্রকে একটা উদাসীন নৈর্ব্যক্তিক শক্তি বলে মনে হয়। সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই বললেই হয়, কিংবা সামান্য যতটুকু বা থাকে তা-ও সম্ভব কেবল সেই ব্যক্তিরই মাধ্যমে, যে তার সংসদীয় প্রতিনিধি। কিন্তু সে যদি শাসক দলের প্রতি আনুগত্যের বশে সরকারের ভুলত্রুটি সম্পর্কে নালিশ শুনতে না চায়, বা যদি হয় এমনই হীনবল বিরোধী পক্ষের সদস্য, যাদের কথা সংখ্যাগরিষ্ঠতার দেমাকে শাসকরা কানেই তোলেন না, তা হলে তো অভিযোগটা সরাসরি পৌঁছে দিতে হয় তারই কাছে, যে এই শাসনযন্ত্রের চালক। কিন্তু সে-ও যদি প্রতিকার করতে অনিচ্ছুক বা অসমর্থ হয়, তা হলে সে অভিযোগ তো সংগতভাবেই শাসক দল ও সরকারের প্রাপ্য বলে বিবেচিত হতে পারে।

প্রাপ্য এ জন্যই যে, রাষ্ট্র-সরকার-পার্টি ইত্যাদি সবই যে-কোনও খেলার দল বা ব্যাঙ্ক বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মতো যৌথ সত্তা (কর্পোরেশন)। অনেক ব্যক্তিকে নিয়ে তৈরি হলেও এগুলি একই উদ্যোগে নিযুক্ত সংস্থা হিসেবে অবিভাজ্য। অতএব, সে উদ্যোগের ফলে কোনও অনিষ্ট ঘটলে সংস্থাটা সমগ্রভাবেই তিরস্কৃত হয়। কখনও কখনও জনমতের আদালতে সমগ্র সরকার ও শাসক দলকেই অভিযুক্তের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে, যদি নাগরিক অধিকার সম্পর্কে তাদের অবজ্ঞা ও অবহেলা শাসিতদের কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে।

গণতন্ত্রকে স্বৈরতন্ত্রে পরিণত করার সে চেষ্টায় যে-সব দল ও শক্তি সে দিন বহু অত্যাচার সহ্য করেও বাধা দিয়েছিল, তারা তাদের সৎসাহসের জন্যই জনমতের দ্বারা পুরস্কৃত হয়।

গণতন্ত্রের গড়নই এ রকম যে, অপশাসন সম্পর্কে নালিশের সুযোগ এবং তা নিয়ে সালিশির ব্যবস্থা না থাকলে নাগরিক জীবন অচল হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকতে পারে। অথচ প্রায়শই দেখা যায়, সুবিচারের এই আদর্শের সঙ্গে অভিজ্ঞতার বাস্তব ঠিক খাপ খায় না। আদর্শ ও অভিজ্ঞতার মধ্যে এই তারতম্যের ফাঁকটাতেই নাগরিকদের অভাববোধ ও অসন্তোষ জমে জমে বিক্ষোভের বারুদে পরিণত হতে পারে।
এই ধরনের বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য যে-সব প্রতিষ্ঠান ও প্রণালী ব্যবহার করা হয়, গণতন্ত্রের রাষ্ট্র-শরীরে তাদের উপযোগিতা মানবদেহে রক্তবাহী শিরা-উপশিরার চেয়ে কম নয়। কারণ, গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য তারই ওপর নির্ভর করে। ওই সব প্রতিষ্ঠান ও প্রণালীর মাধ্যমে নাগরিক অধিকার বা দাবি নিয়ে আপত্তি-অনুযোগ যত দিন আপস-মীমাংসায় মিটে যায়, তত দিনই নির্বাচকদের কাছে সরকারের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে। কিন্তু, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি যখন সালিশির কাজে তৎপরতা হারিয়ে ফেলে, শাসক-শাসিতের মধ্যে সহজ সম্পর্কের প্রণালীগুলি যখন আমলাতান্ত্রিক আবর্জনায় রুদ্ধ হয়ে যায়, তখন প্রতিবাদের মাত্রাও বাড়তে বাড়তে বিক্ষোভে, এমনকি অবস্থাবিশেষে প্রতিরোধে পরিণত হতে পারে।

তার দৃষ্টান্ত এখন বাঙালির দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বিষয়। তার জটিলতার মধ্যে কার্যকারণের সূত্র খোঁজার পরিশ্রম কিছুটা হালকা হয়, যদি মনে রাখি যে, ১) প্রতিবাদ গণতন্ত্রের পরিপন্থী তো নয়ই, বরং তার স্বার্থ ও স্বাস্থ্য অটুট রাখার জন্য আবশ্যক হিতকর উপায়; আর ২) প্রতিবাদ একদিনেই হঠাৎ ফেটে পড়ে না। বেশির ভাগ প্রতিবাদেরই একটা-না-একটা পূর্ব-ইতিহাস থাকে। শাসকদের উদাসীনতা ও অযোগ্যতার ফলে ক্রমে ক্রমে স্ফীত হয়ে কোনও কোনও অবস্থায় তা বিস্ফোরক মাত্রায় পৌঁছতে পারে।

অধিকার আর দায়িত্ব

এ বিষয়ে কখনও কখনও কিছুটা যান্ত্রিকভাবেই আপত্তি তোলা হয় এই বলে যে, প্রতিবাদ অসংগত হবে, যদি না প্রতিবাদী তার দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু প্রতিবাদের ধারণাটা কি সত্যিই দায়িত্বের ধারণার সঙ্গে গাঁটছড়ায় বাঁধা? ধরা যাক, কথা হচ্ছে এমন একটা জমির মালিকানা নিয়ে, যাতে আইনের দিক থেকে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই যে অমুক ফসলটাই চাষ করতে হবে। তাই ধান বোনা হবে, না কাপাস, সে সিদ্ধান্ত মালিকেরই। দায়িত্বের প্রশ্ন এখানে আসেই না। অতএব, অধিকারের সূত্রে, তারই টানে দায়িত্বের কথা যদি কখনও কখনও এসেই যায়, তা হলে সে আলোচনায় পৌর্বাপর্বের এই সম্পর্ক মনে রাখা দরকার। নইলে, লাঙল আগে না বলদ আগে, তার কূটকচালিতে চাষের বেলা কেটে যাবে, খেতের কাজই পণ্ড হবে।

তবু যদি নাগরিক অধিকারের পাশাপাশি দায়িত্বের প্রশ্ন তুলতেই হয়, তা হলেও প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে গণভোটে নির্বাচিত সরকারেরই দায়িত্বে। কারণ, নাগরিকেরা ভেবেচিন্তেই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সরকারের হাতে নিজেদের অধিকার রক্ষার ভার ন্যস্ত করেছে। ফলে, এখন নাগরিক হিসেবে তাদের দায়িত্ব আপসে-সালিশিতে, সভা-সমিতি-শোভাযাত্রা ইত্যাদি নানা মাত্রার প্রতিবাদের দ্বারা তাদের অভাব ও দাবি সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করা এবং দেশবাসীর অধিকার রক্ষার দায়িত্বে তাকে একনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত রাখা। অর্থাৎ, নাগরিকদের দায়িত্বের উৎস তাদের অধিকারেই। সে জন্যই গণতন্ত্রের পক্ষে প্রতিবাদ এত উপকারী, এত অপরিহার্য।

প্রতিবাদের লাভক্ষতি

কিন্তু ব্যর্থ হবে জেনেও কি প্রতিবাদ করা উচিত? প্রতিবাদ বলতে কী বোঝায় তারই ওপর এ প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে। যদি বোঝায় দুই শত্রুপক্ষের মধ্যে মরণান্তিক লড়াই, তা হলেই শুধু হার-জিত, লাভ-ক্ষতির কথা উঠতে পারে। কিন্তু সে প্রতিবাদের সঙ্গে আমাদের বক্তব্যের কোনও যোগ নেই। আমরা যে প্রতিবাদের কথা ভাবছি, তার মধ্যে শত্রুতা নেই, কারণ তা নাগরিকদের ও তাদের নির্বাচিত সরকারের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা এমন কিছু সমস্যা নিয়ে, যা আপসেই মিটিয়ে ফেলা যায়। মেটানো যায় এ জন্যই যে, সমস্যাগুলি নাগরিকদের অধিকার সংক্রান্ত।

আর গণতন্ত্রী সরকার যেহেতু নাগরিকদেরই সম্মতি অনুযায়ী সে-অধিকার রক্ষার দায়িত্ব পেয়েছে, তাই দুই মিত্রপক্ষের মধ্যে নিরন্তর আপসের চেষ্টা চলছে এবং বিশেষ এক পর্যায়ে এসে তা প্রতিবাদে রূপায়িত হয়েছে। আশা থাকে যে, গণ আর তন্ত্র এ দুই বন্ধু হাতে হাত মেলাবেই। অন্য উপায়ে যদি মীমাংসা না-ও হয়, তা হলেও শেষ পর্যন্ত আবার নির্বাচনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের বুদ্ধি, বিবেচনা ও হিতাহিত জ্ঞানই তাদের সাময়িক মতভেদের নিষ্পত্তি করবে।

এমার্জেন্সির নাম করে ইন্দিরা গাঁধী যখন মৌলিক নাগরিক অধিকারগুলি কেড়ে নিয়ে প্রতিবাদের কণ্ঠ রোধ করতে চান, তখন নির্বাচকদের প্রতিবাদী ভোটেই তাঁর দলের দর্প চূর্ণ হয়। কিছু কাল বাদে একই নেতৃত্বে একই দল আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে ঠিকই, কিন্তু তত দিনে তাদের বিষদাঁত ভেঙেছে, কাজে ও কথায় আগেকার সেই ঔদ্ধত্যের ঝাল আর নেই। গণতন্ত্রকে স্বৈরতন্ত্রে পরিণত করার সে চেষ্টায় যে-সব দল ও শক্তি সে দিন বহু অত্যাচার সহ্য করেও বাধা দিয়েছিল, তারা তাদের সৎসাহসের জন্যই জনমতের দ্বারা পুরস্কৃত হয়। কোথাও সে কথা মনে রেখেই নাগরিকরা বিশ্বাস করে তাঁদেরই শাসকের আসনে বসিয়েছে। কিন্তু আজ যদি তাঁরাও ঔদ্ধত্যের বশে বিশ্বাসভঙ্গ করেন, তা হলে গণতন্ত্রই আবার তাদের ভুল ভাঙাবে।

গণতন্ত্রের গড়নই এ রকম যে, অপশাসন সম্পর্কে নালিশের সুযোগ এবং তা নিয়ে সালিশির ব্যবস্থা না থাকলে নাগরিক জীবন অচল হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকতে পারে

ক্ষমতার গদিতে কে বসেছে বা বসেনি, তার খতিয়ানই প্রতিবাদের মূল্য সম্পর্কে শেষ কথা নয়। প্রতিবাদের ভিত্তি প্রতিবাদীর আত্মশক্তিতে। প্রতিবাদ যদি ন্যায়সংগত হয়, যে-কোনও হিসেবেই তা জমা পড়বে লাভের কোটায়। প্রথমত, আত্মশক্তি নাগরিকের বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন করে তোলে, সকলের মঙ্গলের জন্য সমবেত উদ্যোগে মিলিত হতে উদ্বুদ্ধ করে। এ ভাবেই প্রতিবাদের মাধ্যমে আত্মশক্তি পরিণত হয় গণশক্তিতে, আর তারই ফলে গণতন্ত্রের প্রসার ও গভীরতা বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয়ত, আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ বলেই মানুষ তার মনুষ্যত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। সব জীবের মধ্যে সে যে তার মানবিক বিবেকে, শুভবুদ্ধিতে, সংকল্পে সম্পূর্ণ আর এক প্রকার সত্তা, এই চেতনার উদ্ভাসে নিজের সঙ্গে সে নিজে মুখোমুখি হয়। এ সাক্ষাৎকার কি কখনওই ক্ষতিকর হতে পারে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.