শস্য রপ্তানি চুক্তি থেকে পুতিন কেন বেরিয়ে যেতে চাইছেন

রয়টার্সের বিশ্লেষণ

0
211
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ছবি: এএফপি

ইউক্রেনে রাশিয়ার চলমান হামলা ও কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো অবরুদ্ধ করে রাখার জেরে বৈশ্বিক খাদ্যসংকটের আশঙ্কা দেখা দেয়। এ অবস্থায় গত বছরের জুলাইয়ে জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় ‘কৃষ্ণসাগর শস্য চুক্তি’ (ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনেশিয়েটিভ) বা শস্য রপ্তানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এখন বলছেন, তিনি আর এই চুক্তিতে থাকবেন না। কারণ হিসেবে তিনি দাবি করছেন, পশ্চিমারা এখনো মস্কোর সঙ্গে প্রতারণা করছে। বিশ্ববাজারে রাশিয়ার কৃষিপণ্য পৌঁছানোর পথে তারা বাধা সৃষ্টি করছে।

চলতি মাসের গোড়ায় রুশ প্রেসিডেন্টের দেওয়া এ ঘোষণা অনুযায়ী চুক্তির বিষয়ে আজ শনিবার মস্কো সফররত আফ্রিকার নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা।

কী আছে চুক্তিতে

শস্য রপ্তানির এই চুক্তির আওতায় ইউক্রেনের তিন সমুদ্রবন্দর চোরনোমর্স্ক, ওদেসা ও পিভদেনেই (ইয়ুঝনি) থেকে খাদ্য ও ওষুধ রপ্তানি করা যায়। এরই মধ্যে চুক্তির মেয়াদ তিন দফায় বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ মেয়াদ বৃদ্ধি হয়েছে আগামী ১৭ জুলাই পর্যন্ত।

এ চুক্তির আওতায় এ পর্যন্ত প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ টন পণ্য ইউক্রেন থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। এই পণ্যের অধিকাংশই বিভিন্ন খাদ্যপণ্য ও গম। চুক্তির মাধ্যমে অ্যামোনিয়া সারও নিরাপদে বিভিন্ন দেশে পাঠানো সম্ভব। যদিও সারের অন্যতম এই উপাদানের কোনো জাহাজ এখনো রাশিয়ার কোনো বন্দর ছেড়ে যায়নি।

চুক্তিটি সইয়ে রাশিয়াকে রাজি করাতে তিন বছর মেয়াদি আরেকটি চুক্তিতে সম্মত হতে হয় জাতিসংঘকে। দ্বিতীয় সেই চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়ার নিজস্ব খাদ্যপণ্য ও সারের চালান অন্যান্য দেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনো বাধা এলে তা দূর করায় জাতিসংঘ সহযোগিতা করবে।

জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক গত সপ্তাহে বলেন, গত মাসগুলোয় রাশিয়ার রপ্তানি পরিস্থিতির ‘বাস্তব অগ্রগতি’ ঘটেছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, ‘এখনো চ্যালেঞ্জ রয়েছে।’ দুজারিকের কথায়, ‘বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলায় আমরা চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখব না।’

কেন চুক্তির প্রয়োজন

বিশ্বব্যাপী খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ভুগছে গরিব দেশগুলো। গত বছরের মার্চে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এই বলে সতর্ক করে যে বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের সাড়ে ১২ কোটি মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। কেননা, খাদ্যশস্যের ৫০ শতাংশই আসে ইউক্রেন থেকে।

চুক্তিটি সইয়ে রাশিয়াকে রাজি করাতে তিন বছর মেয়াদি আরেকটি চুক্তিতে সম্মত হতে হয় জাতিসংঘকে। দ্বিতীয় সেই চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়ার নিজস্ব খাদ্যপণ্য ও সারের চালান অন্যান্য দেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনো বাধা এলে তা দূর করায় জাতিসংঘ সহযোগিতা করবে

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আফ্রিকা ৩৭০ কোটি টন গম আমদানি করে রাশিয়া থেকে, যা আফ্রিকার মোট রপ্তানির ৩২ শতাংশ। একই সময়ে ইউক্রেন থেকে ১৪০ কোটি টন আমদানি করে, যা মহাদেশটির মোট রপ্তানির ১২ শতাংশ।

গত বছর জাতিসংঘ জানায়, ৩৬টি দেশ তাদের চাহিদার অর্ধেকের বেশি গম রপ্তানি করে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। এসব দেশের তালিকায় লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া ও কঙ্গোর মতো অত্যন্ত গরিব ও নানা কারণে নাজুক অবস্থায় থাকা দেশ।

কৃষ্ণসাগর শস্য চুক্তির আওতায় ৬ লাখ ২৫ হাজারের বেশি খাদ্যশস্য সংগ্রহ করেছে ডব্লিউএফপি। এসব খাদ্যশস্য আফগানিস্তান, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, সোমালিয়া ও ইয়েমেনে সহায়তা হিসেবে দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালে ডব্লিউএফপি তাদের বৈশ্বিক চাহিদার অর্ধেকের বেশি গম ইউক্রেন থেকে সংগ্রহ করেছে।

রাশিয়ার যত অভিযোগ

রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের অভিযোগ, রাশিয়ার নিজেদের পণ্য রপ্তানি এখনো না বাধার মুখে পড়ছে। কেননা, পশ্চিমারা তাদের প্রতারণা অব্যাহত রেখেছে।

যদিও রাশিয়ার এ অভিযোগ মানতে নারাজ যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড গত মাসে বলেন, ‘একই হারে খাদ্যশস্য ও সার রপ্তানি করছে তারা (রাশিয়া)।’

কৃষ্ণসাগর শস্য চুক্তির আওতায় ৬ লাখ ২৫ হাজারের বেশি খাদ্যশস্য সংগ্রহ করেছে ডব্লিউএফপি। এসব খাদ্যশস্য আফগানিস্তান, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, সোমালিয়া ও ইয়েমেনে সহায়তা হিসেবে দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালে ডব্লিউএফপি তাদের বৈশ্বিক চাহিদার অর্ধেকের বেশি গম ইউক্রেন থেকে সংগ্রহ করেছে

পুতিন বলছেন, রাশিয়া চুক্তিতে রাজি হয়েছিল আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর কথা চিন্তা করে। যদিও বিশ্বের সবচেয়ে গরিব দেশগুলো মাত্র মাত্র ৩ দশমিক ২ থেকে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ খাদ্যশস্য নেয়। এর বিপরীতে ধনী দেশগুলোর কাছে যায় ৪০ শতাংশ খাদ্যশস্য।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তির অধীন আমদানির প্রায় ৩ শতাংশ যায় কম আয়ের দেশগুলো, উচ্চ আয়ের দেশগুলোয় যায় প্রায় ৪৪ শতাংশ এবং বাকিটা যায় মধ্যম আয়ের দেশগুলোয়।

জাতিসংঘ বরাবরই বলে আসছে, চুক্তিটি মূলত বাণিজ্যিক চিন্তা থেকেই করা হয়েছে, পুরোপুরি মানবিক দিকে মনোযোগ দিয়ে করা হয়নি। তবে যেহেতু চুক্তিটি বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যে দাম কমাতে সাহায্য করছে, ফলে গরিব দেশগুলো লাভবান হচ্ছে।

রাশিয়ার দাবিদাওয়া

গত মার্চ মাসে জাতিসংঘকে দেওয়া এক চিঠিতে রাশিয়া তাদের দাবিদাওয়া তুলে ধরেছে। তাদের বক্তব্য, এসব দাবিদাওয়া পূরণ হলেই কেবল চুক্তি অব্যাহত রাখা হবে।

উল্লেখযোগ্য দাবির মধ্যে রয়েছে—মস্কো চায় রাশিয়ার অ্যাগ্রিকালচারাল ব্যাংককে (রোসেল্কহজব্যাংক) আন্তর্জাতিক লেনদেন-ব্যবস্থা সুইফটের (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) সঙ্গে পুনরায় যুক্ত করা হোক। ইউক্রেনে হামলা শুরুর জেরে গত বছরের জুন মাস সুইফট থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়ার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে সুইফটের সঙ্গে পুনরায় সংযুক্ত করার কথা তাঁরা চিন্তা করছেন না।

গত সপ্তাহে রাশিয়া অভিযোগ করে, ইউক্রেনের খারকিভ অঞ্চলে একটি পাইপলাইন ইউক্রেনের বাহিনী উড়িয়ে দিয়েছে। অ্যামোনিয়া পরিবহনে এটি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ পাইপলাইন। তবে ইউক্রেনের আঞ্চলিক গভর্নর উল্টো দাবি করেন, রাশিয়াই পাইপলাইনের ওপর গোলা নিক্ষেপ করেছে। যদিও কোনো পক্ষই তাদের বক্তব্যের সপক্ষে কোনো প্রমাণ হাজির করেনি।

কৃষির যন্ত্রপাতি ও এর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ রপ্তানির সুযোগও ফিরে পেতে চায় রাশিয়া। বিমা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়াসহ রাশিয়ার জাহাজ ও কার্গো ভেড়ার জন্য বন্দরগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়ারও দাবি জানিয়েছে মস্কো। একই সঙ্গে রুশ সার কোম্পানিগুলোর আর্থিক কর্মকাণ্ড ও হিসাবগুলো পুনরায় সক্রিয় করার দাবি জানানো হয়েছে।

গত বছরের জুলাইয়ে সই হওয়া ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনিশিয়েটিভ নামের চুক্তির ফলে কৃষ্ণসাগরীয় বন্দরগুলো দিয়ে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির সুযোগ উন্মোচিত হয়
গত বছরের জুলাইয়ে সই হওয়া ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনিশিয়েটিভ নামের চুক্তির ফলে কৃষ্ণসাগরীয় বন্দরগুলো দিয়ে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির সুযোগ উন্মোচিত হয়, প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

রাশিয়ার খাদ্যশস্য ও সার রপ্তানি

ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়ার গম ও কিছু সারের রপ্তানি বেড়েছে। তবে অ্যামোনিয়া ও পটাশিয়ামযুক্ত সার রপ্তানির গ্রাফ নিম্নমুখী।

২০২১-২২ সময়ে রাশিয়া ৩ কোটি ৮১ লাখ টন খাদ্যশস্য রপ্তানি করেছে। পরে ২০২২-২৩ সময়ে প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছিলেন, তাঁর দেশ সাড়ে ৫ কোটি থেকে ৬ কোটি টন রপ্তানি আশা করে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড হতে যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার গম মূলত রপ্তানি হয় মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোয়। তবে ২০২২-২৩ সময়ে বিশ্বের সব অংশেই তাদের এই খাদ্যশস্যের রপ্তানি বেড়েছে।

অন্যদিকে, আরেকটি বাণিজ্যিক হিসাব বলছে, ২০২২ সালে রাশিয়ার ইউরিয়া, পটাশিয়ামভিত্তিক সার ডায়ামোনিয়াম ও মোনামোনিয়াম ফসফেটের রপ্তানি বেড়েছে। তবে পটাশিয়ামভিত্তিক সার মিউরেট অব পটাশের (এমওপি) রপ্তানি কমেছে ৩৭ শতাংশ।

রয়টার্স

মস্কো

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.