শর্তের জালে সংলাপ

নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সংকট

0
175
নির্বাচন ভবন।

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে অনড় অবস্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। নির্বাচনের মাত্র আট মাস বাকি থাকলেও রাজনৈতিক সংকট সমাধানের কোনো লক্ষণ নেই।  বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে নিজেদের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছে দু’পক্ষই। সর্বশেষ নির্বাচন কমিশনের সংলাপের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি বলেছে, এটি সরকারের নতুন কৌশল। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচন প্রশ্নে এবার বিএনপি ভিন্ন কৌশল নিয়েছে।

দুই প্রধান দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে সংলাপ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যে জনমনে হতাশা বাড়ছে। দু’পক্ষের কঠোর অবস্থানে যেন শর্তের জালে বন্দি হয়ে পড়েছে সংলাপের সম্ভাবনা। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সংকট আরও গভীর হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাঁরা মনে করেন, সংকট সমাধানে সংলাপই হতে পারে উত্তম পথ। অন্যথায় সংঘাতের পথে যেতে পারে রাজনীতি।

সর্বশেষ শনিবার আওয়ামী লীগের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মনে হয় বিএনপি আগামী নির্বাচনে আসবে না। এবার তাদের কৌশলটা ভিন্ন। আচরণ রহস্যজনক। অন্যদিকে, সংলাপের জন্য বিএনপিকে নির্বাচন কমিশনের চিঠি দেওয়ার বিষয়টি সরকারের নতুন কৌশল বলে মন্তব্য করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি এও বলেছেন, সারাবিশ্বের চাপে সরকার নতুন নতুন কৌশল বের করছে। কমিশনের চিঠি দেওয়ার ঘটনাও সেই কৌশলের অংশ।

এর আগে ১৩ মার্চ গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে সংলাপের সম্ভাবনা এক প্রকার নাকচ করেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গত নির্বাচনে সংলাপ করেছি, রেজাল্টটা কী, নির্বাচনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ ছাড়া কিছুই করেনি। ১৫ আগস্ট আমার বাবা-মাকে হত্যা, গ্রেনেড হামলা, বোমা হামলা করে আমাকে হত্যার চেষ্টার পরও তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছি শুধু দেশের স্বার্থে। এত অপমানের পর তাদের সঙ্গে কীসের বৈঠক? আমার পরিষ্কার কথা, যারা এইটুকু ভদ্রতা জানে না, তাদের সঙ্গে বৈঠকের কী আছে।’
পরদিন ১৪ মার্চ গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের জবাব দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আমরা তো আগেই বলেছি, তাঁর (প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে সংলাপ করব না। তিনি তো কথাই রাখেন না। আমরা সেজন্য ডায়ালগের কথা একবারের জন্য বলিনি।’

বিএনপি বলছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে, এটা নীতিগতভাবে মেনে নিলে সংলাপে বসতে তাদের আপত্তি নেই। আওয়ামী লীগের বক্তব্য হলো, শর্ত দিয়ে সংলাপ হবে না, যা কিছু হবে সংবিধানের অধীনেই হতে হবে। তবে উভয় পক্ষের সিনিয়র নেতারা আশাবাদী এ মুহূর্তে না হলেও নির্বাচনের আগে সংলাপ হতে পারে।

সংকট উত্তরণে দু’পক্ষ এগিয়ে না এলে সংঘাতের আশঙ্কা করছেন দেশের বিশিষ্টজন। তাঁদের মতে, নানা কারণে দু’পক্ষের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলে আপাতদৃষ্টিতে সংলাপের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

তবে দুই দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনের আগে যে কোনো পর্যায়ে সংলাপ হতে পারে। বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন হলে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে– এটা স্বীকার করে আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা বলেছেন, আপাতত সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করা হলেও আর কখনোই হবে না তা বলার সময় আসেনি।

অন্যদিকে বিএনপি বলছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না, এটা প্রমাণিত। তাই সরকারি দলকে আগে নীতিগতভাবে মানতে হবে, দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্থায়ী পদ্ধতি বা কাঠামো সৃষ্টিতে তারা আন্তরিক।

বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক মনে করছেন, এই মুহূর্তে সংলাপের সম্ভাবনা নেই। তিনি আশঙ্কা করছেন, সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা না হলে পরিণতি হবে খুবই ভয়াবহ। চরম রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সাধারণ মানুষ। শাহ্‌দীন মালিক আরও বলেন, বিএনপি মনে করছে, বর্তমান সরকারকে তারা আন্দোলনের মাধ্যমে পদত্যাগে বা কোণঠাসা করতে বাধ্য করবে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ মনে করছে, বিএনপিকে তারা দমন করতে পারবে। সরকারের এই দমননীতির ফলে দেশ একটা অত্যাচারী বা পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হবে বলেও তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, যে কোনো সংকটেই একমাত্র সমাধানের পথ সংলাপ। দেশের প্রধান দুই দলের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের অভাবের কারণেই বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তারপরও দেশের স্বার্থে সমঝোতার জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। তিনি বলেন, নানা মতপার্থক্যের মধ্যেই ন্যূনতম ঐকমত্য সৃষ্টিই হলো রাজনীতি। জাতীয় নির্বাচনের এখনও সময় আছে। এই সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের আস্থার সংকট দূর করতে উদ্যোগী হবে– এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, সংলাপে বসার আগেই ন্যূনতম মতৈক্য তৈরি করতে হবে। সংবিধানের আওতায় থেকে উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেই দ্রুত সমাধান পাওয়া যাবে। অতীতের সংলাপ সফল না হওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আরেফিন সিদ্দিক বলেন, শুধু সংলাপ করে লাভ হবে না, যদি তার সিদ্ধান্তগুলো মেনে চলা না হয়। লোক দেখানো সংলাপ করে সমস্যার সমাধান হবে না।

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে আরেকটি রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বিকল্প নেই। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিল একটা স্থায়ী রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ওই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাতিল করা হয়। তিনি বলেন, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য গঠিত সংসদীয় কমিটির সুপারিশেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত এসেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির কারণে তখন এই পদ্ধতি বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হয়। এতে নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। তিনি বলেন, যে কোনো উপায়ে আরেকটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত না হলে পরবর্তী নির্বাচনও বিতর্কিত হতে বাধ্য।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, তাঁর দল চায় আগামী নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে। দেশের উন্নয়নের জন্য এটা অপরিহার্য। সংলাপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক মন্তব্যকে দলের স্থায়ী অবস্থান নয় জানিয়ে তিনি বলেন, সংলাপ হবে না, এর অর্থ এই নয় কোনো দিনই হবে না, প্রধানমন্ত্রী তা বলেননি। বিএনপি বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না এবং এখান থেকে এক চুলও সরে আসার সুযোগ নেই। এই অবস্থান থেকে বিএনপিকে সরে আসতে হবে। নীতিগতভাবে আওয়ামী লীগ কখনোই সংলাপের বিরুদ্ধে নয়। বিশ্বজুড়েই সংঘাত ও সংকট এড়ানোর উপায় হলো সংলাপ। সামনের দিনগুলোতে অবশ্যই সংলাপ হবে। যে কোনো সংলাপের পেছনে একটা আলোচনা থাকে। সেই পেছনের আলোচনা তো কিছুই হচ্ছে না। তাই এখনই এ বিষয়ে মন্তব্য করার সময় আসেনি।

দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্থায়ী পদ্ধতি খুঁজে বের করার কোনো পরিকল্পনা আওয়ামী লীগের রয়েছে কিনা– এ প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী বলেন, বিএনপি একটি বড় দল। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য স্থায়ী পদ্ধতি খুঁজে বের করে অবশ্যই তাদের নির্বাচনে আনতে হবে। বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে আওয়ামী লীগের প্রচেষ্টার কোনো কার্পণ্য থাকবে না। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের চেষ্টা সংবিধানের আলোকে করতে হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর। এই ক্ষমতা হস্তান্তর হবে জনগণের ভোটের মাধ্যমে। বর্তমান সরকার ভোটের পদ্ধতি রুদ্ধ করে রেখেছে। দুই-তিনটি নির্বাচন এভাবে করে তারা ক্ষমতায় রয়েছে। এবারও একই পথে হাঁটছে। বিশ্বে যেখানে এমন সরকারের আবির্ভাব ঘটেছে, সেখানেই জনগণকে আন্দোলনের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ তৈরি করতে হয়েছে। বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিকে গণআন্দোলনের পথেই হাঁটতে হবে। কারণ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পরে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা একনায়করা হস্তান্তর করেছে– এমন নজির বিশ্বের কোথাও নেই। তিনি আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তারা এককভাবে বাতিল করে গায়ের জোরে ক্ষমতায় থাকার পথ তৈরি করেছে। বিএনপি শুধু এই নির্বাচনের জন্যই নয়, স্থায়ীভাবে জনগণের ভোটাধিকার আদায়ের আন্দোলন করছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.