যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো উদ্বেগ দেখাচ্ছে না আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের শরিকেরা। তাদের অনেকে এটিকে দেখছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘রাজনীতি’ হিসেবে। একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন এই জোটের শরিক দলগুলোর নেতাদের অনেকে মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থানের কারণে সরকারের ওপর একধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। আর এই প্রক্ষাপটে আবারও তাঁদের জোটের রাজনীতির গুরুত্ব বাড়বে এবং আওয়ামী লীগের কাছে কদর বাড়বে শরিকদের।
১৪–দলীয় জোটে ওয়ার্কার্স পার্টিসহ কায়েকটি বামপন্থী দল রয়েছে। ওই বামপন্থী দলগুলো ইতিমধ্যে বিবৃতি দিয়ে মার্কিন নীতির সমালোচনা করেছে। তবে প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ এখনো জোটের অন্য শরিকদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই ভিসা নীতির ব্যাপারে কোনো আলোচনা করেনি। আগামী দু–এক দিনের মধ্যে জোটের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে সম্প্রতি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার প্রক্রিয়ায় যারা বাধা সৃষ্টি করবে, তাদের বিধিনিষেধের আওতায় আনা হবে। এই নীতি নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সতর্ক প্রতিক্রিয়া দেখানো হলেও তাদের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিকেরা খোলামেলা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি আরোপ করে বাংলাদেশকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছে। এর সঙ্গে দেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখার কোনো বিষয়ই নেই। আরেক শরিক জাসদ যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের সমালোচনা করে বলেছে, দেশের জনগণের এই ভিসা নীতি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই।
আওয়ামী লীগ, সরকারের পাশাপাশি বিরোধী দল বিএনপিও যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতিকে একটি সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছে। এটি দেশে নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে বলে মনে করছে বিএনপি। দলটি বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির মাধ্যমে তাদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়েছে। এখন বিএনপি নতুন ধাপে আন্দোলনের কৌশল ও কর্মসূচি ঠিক করতে যাচ্ছে। বিপরীতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলায় মাঠে আগের চেয়ে বেশি সক্রিয় থাকার কৌশল নিয়েছে।
ক্ষমতাসীনেরা এককভাবেই মাঠে থাকবে নাকি জোটগতভাবে থাকবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। জোটের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, শিগগিরই জোটের একটি বৈঠকে এই বিষয় আলোচনায় আসবে।
১৪ দলের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, দু–এক দিনের মধ্যে ১৪ দলের বৈঠক হবে। মার্কিন ভিসা নীতি নিয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগ যে অবস্থান ঘোষণা করা হয়েছে, তার সমর্থনে জোটের বৈঠকে আলোচনা হবে।
জোটের সূত্র জানায়, এখন ১৪–দলীয় জোট রাজনীতির মাঠে সেভাবে সক্রিয় নয়। তবে ইতিমধ্যে জোটনেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোটের নেতাদের জানিয়েছেন যে আগামী নির্বাচন ১৪ দল জোটগতভাবে করবে।
ভোটের হিসাবে ১৪–দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর খুব বড় অংশ না থাকলেও রাজনীতির মাঠে জোটের নেতাদের কারও কারও একধরনের প্রভাব আছে। এখন জাতীয় নির্বাচনের আগে জোট কতটা গুরুত্বপূর্ণ হবে, তা বেশ কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের আগেভাগেই সরকারের ওপর চাপ তৈরি হলে স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগের কাছে শরিকদের গুরুত্ব বাড়বে। তখন আওয়ামী লীগ শরিকদের আরও বেশি কাছে টানবে। যাতে বিরোধী সুর আরও বড় হওয়ার সুযোগ তৈরি না হয়। অন্যদিকে বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি না বা তারা আন্দোলনে কতটা চাপ তৈরি করতে পারবে—সেই প্রেক্ষাপটেও ১৪–দলীয় জোটে শরিকদের গুরুত্ব বাড়বে। এমন ধারণা করছেন শরিক দলগুলোর নেতারা। তাঁরা এটিও মনে করছেন যে সরকারের পাশাপাশি বিএনপিও যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির ফলে একধরনের চাপে পড়েছে।
১৪ দলের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘মার্কিন এই ভিসা নীতির সঙ্গে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্পর্ক আছে বলে তিনি মনে করেন না। এটি খুব বড় প্রভাব ফেলবে, সে রকমও নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক খেলা শুরু করেছে, এটা তার প্রতিফলন।
এই নীতি ঘোষণার পর ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তির সমর্থকেরা এবং এক–এগারো সৃষ্টিতে যুক্ত ছিল, এমন শক্তিগুলো উৎফুল্ল হয়েছে। তারা এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।’ তিনি মনে করেন, এই পরিস্থিতিতে ১৪–দলীয় জোটের রাজনীতি আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকা উচিত। এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা উচিত। এখন জোটকে আরও ঐক্যবদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে সেটা নির্ভর করবে আওয়ামী লীগ কীভাবে বিষয়টি মোকাবিলা করবে, তার ওপর।
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে রাজনৈতিকভাবে আলোচনার খুব একটা জায়গা নেই বলে মনে করেন ১৪ দলের আরেক শরিক জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে এই ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। এর সঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচন বা গণতন্ত্র রক্ষার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশও নিজেদের অভ্যন্তরীণ স্বার্থ দেখে পদক্ষেপ নেবে। এখানে সংঘাতের কোনো জায়গা নেই। দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও একই থাকবে।
ক্ষমতাসীন জোটের শরিকেরা তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের সমালোচনা করছে। আর আওয়ামী লীগ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। জোটের নেতারা বলছেন, অল্প সময়ের মধ্যে তাঁরা আলোচনা করে বিষয়টিতে জোটের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তুলে ধরবেন।