লোহার খাঁচায় দাঁড়াতে হলো, অভিশপ্ত জীবনের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছি: মুহাম্মদ ইউনূস

0
49
শুনানি শেষে আজ রোববার দুপুরে ঢাকার আদালত চত্বরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা ড. মুহাম্মদ ইউনূস

ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানি হয়েছে আজ। এ জন্য ঢাকার আদালতের এজলাসকক্ষে আসামিদের জন্য তৈরি করা লোহার খাঁচায় (আসামির কাঠগড়া) দাঁড়াতে হয়েছিল এই নোবেল বিজয়ীকে। এই অভিজ্ঞতাকে ‘অভিশপ্ত জীবনের অংশ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি।

ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এ আজ এই মামলার শুনানি হয়। বিচারক সৈয়দ আরাফাত হোসেন ১২ জুন অভিযোগ গঠনের বিষয়ে আদেশের জন্য দিন রেখেছেন।

ড. ইউনূসের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, শুনানির শুরুতে আদালত ড. ইউনূস ছাড়া বাকি আসামিদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বলেন। তখন ড. ইউনূস বলেন, তাঁর জন্য অন্যদের এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাই তিনি নিজেও লোহার খাঁচায় তৈরি আসামির কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ান। মিনিট দুয়েক পর সবাই বিচারকের অনুমতি নিয়ে এজলাসকক্ষের বেঞ্চে গিয়ে বসেন।

শুনানি শেষে দুপুরে ঢাকার আদালত চত্বরে ড. ইউনূস সাংবাদিকদের বলেন, ‘লোহার খাঁচার তৈরি আসামির কাঠগড়া তো অপমানজনক। অপমান করার জন্য এটি করা হয়েছে। এটা তো আর সম্মান দেওয়ার জন্য বানানো হয়নি। অপমানের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বানানো হয়েছে। আজ আমি অভিশপ্ত জীবনের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছি। এই প্রথম আমাকে লোহার খাঁচায় দাঁড়াতে হলো।’

বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখার জন্য আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁকে হয়রানি না করতে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শতাধিক নোবেল বিজয়ীসহ সাবেক ও বর্তমান অনেক রাষ্ট্রপ্রধান।

তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তার কোনো ভিত্তি নেই বলে দাবি করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার মধ্যে কোনো সত্যতা নেই। যে জিনিস আমি দিয়ে দিয়েছিলাম, সেটার জন্য আমাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। আমার সঙ্গীরা আজ অভিশপ্ত। এটা আমার মনে কঠিনভাবে দাগ কেটেছে। আমার পরিবারকে আক্রমণ করেছে। আমার বাবাকে আক্রমণ করেছে। এটা আমার কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এটা আমার অভিশপ্ত জীবনের অংশ।’

গ্রামীণ টেলিকমের কর্মীদের লভ্যাংশের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা এই মামলায় গত ১ ফেব্রুয়ারি ড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় দুদক।

ড. ইউনূস ছাড়া অভিযোগপত্রে গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল ইসলাম, পরিচালক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান; পরিচালক পারভীন মাহমুদ, নাজনীন সুলতানা, মো. শাহজাহান, নূরজাহান বেগম এবং এস এম হাজ্জাতুল ইসলাম লতিফী, আইনজীবী মো. ইউসুফ আলী ও জাফরুল হাসান শরীফ; গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান, শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের প্রতিনিধি মো. মাইনুল ইসলাম এবং জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের দপ্তর সম্পাদক মো. কামরুল হাসানকে আসামি করা হয়।

অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিদের মধ্যে কামরুল হাসানের নাম তদন্তের পর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অপর ব্যক্তিদের নাম এজাহারে ছিল। দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বাদী হয়ে গত বছরের ৩০ মে মামলাটি করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আসামিরা ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে, যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ।

৮৪ বছর বয়সী মুহাম্মদ ইউনূস জীবনের এই সময়ে এসে মামলাসহ নানা সমস্যার মুখোমুখি হওয়া নিয়ে এর আগেও অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। আজ তিনি বলেছেন, লোহার খাঁচার তৈরি আসামির কাঠগড়াকে দেখছেন প্রতীকী হিসেবে।

তিনি আসলে এক ‘অভিশপ্ত জীবন’ বয়ে বেড়াচ্ছেন উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘এখানে আমার কিছু করার নেই। এটা দেব–দেবীর ইচ্ছা। দেব-দেবী ঠিক করেন কাকে অভিশাপ দিতে হবে।’

এই ‘অভিশপ্ত জীবনের’ ব্যাখ্যা দিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমি বসে বসে চিন্তা করছিলাম, মহাকাব্যে কিছু দেব–দেবী থাকে। তারা অভিশাপ দেয়। যাদের অভিশাপ দেয়, তারা অভিশপ্ত জীবনযাপন করে। আমিও মনে হয়, কোনো মহাকাব্যের অংশ হয়ে গেছি। কোনো দেব–দেবী আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছে। তাদের অভিশাপের কারণে আজ আমি এখানে।’

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমাকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বের করে দেওয়াটা ছিল আমার অভিশপ্ত জীবনের অংশ। আমার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে, তদন্ত কমিশন হয়েছে। আজ আমি অভিশপ্ত জীবনের বড় পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। বন্ধুরা যদি দেখত আমি লোহার খাঁচার মধ্যে আছি, তাদের অনেক খারাপ লাগত।’

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.