অনুদানের অর্থ কমে যাওয়ায় কক্সবাজারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের খাদ্য বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। বরাদ্দ কমায় দুর্ভোগে পড়েছে রোহিঙ্গারা। এর ফলে ক্যাম্পে দিন দিন বাড়ছে অস্থিরতা। নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা। এতে উদ্বিগ্ন স্থানীয় বাসিন্দারা। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের দ্রুত মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের যে আন্তর্জাতিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, তা চলতি বছর দুই ধাপে কমে মাথাপিছু মাসে আট ডলারে চলে এসেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেটা আরও কমতে পারে। খাদ্য বরাদ্দ কমানোর ফলে রোহিঙ্গাদের সার্বিক দুর্গতি আরও বাড়বে। বিশেষ করে পুষ্টি-স্বাস্থ্যসহ জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
তিনি বলেন, খাদ্যের অভাবে একটি জনগোষ্ঠীতে যেসব নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তার সবই আমরা রোহিঙ্গাদের মাঝে এখন দেখতে পাচ্ছি। বিশেষ করে ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে। এ ছাড়া খাদ্যের সন্ধানে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে তারা। এতে সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে।
ডব্লিউএফপি ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার পাশাপাশি খাদ্য বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে জাতিসংঘ। এ কারণে অর্থ সংকটে পড়েছে রোহিঙ্গারা। তিন মাসের ব্যবধানে ডব্লিউএফপি দুই দফা কমিয়েছে অর্থ বরাদ্দ। চলতি বছরের মার্চে রোহিঙ্গাদের জনপ্রতি মাসিক বরাদ্দ ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করা হয়। সর্বশেষ গত ১ জুন থেকে ওই বরাদ্দ আরও কমিয়ে আট ডলার (৮৭০ টাকা) করা হয়েছে। এ কারণে ক্যাম্পে পুষ্টি-স্বাস্থ্যসহ জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা হালিমা বেগম (৪২) বলেন, ‘বর্তমানে যে পরিমাণ রেশন দেওয়া হচ্ছে, তা দিয়ে সংসার চলে না। এতে আমার স্বামী ও ছেলেরা ক্যাম্পের বাইরে কাজ করতে যেতে বাধ্য হয়। ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে মাসে ১০-১৫ দিন মজুরি দেয় তারা। যারা ক্যাম্পের বাইরে যেতে পারে না, তাদের সংসার চলছে কষ্টে।’
হতাশার কথা জানিয়ে উখিয়ার লম্বাশিয়া ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতা মাস্টার জোবাইর (৪৫) বলেন, ‘রোহিঙ্গারা আগে যে পরিমাণ রেশন পেত, এখন তা পাচ্ছে না। এতে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে অর্থ সংকট দেখা দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ক্যাম্পে নানা ধরনের অপরাধের পাশাপাশি অস্থিরতা আরও বাড়বে।’
উখিয়ার ক্যাম্প-১-এর রোহিঙ্গা নারী জামিলা (২৫) বলেন, ‘আমি অন্তঃসত্ত্বা। এখন আমার বেশি বেশি খাওয়া উচিত। কিন্তু খাওয়া-দাওয়া ঠিকভাবে করতে পারছি না। কারণ খাদ্য কমে গেছে, কোনো ধরনের পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছি না। গর্ভের বাচ্চা নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় রয়েছি।’
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। এ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। আশ্রয়শিবিরগুলোয় রোহিঙ্গারা ২৫ আগস্টকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ইঞ্জিনিয়ার হেলাল উদ্দিন বলেন, খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেওয়ায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। কারণ, কাজের সন্ধানে প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে যাচ্ছে; শ্রমিকের কাজ করছে। আবার কেউ কেউ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। এতে আমরা শঙ্কিত।
অভিযানের সিদ্ধান্ত কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরগুলোতে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হবে। বুধবার উখিয়ার শফিউল্লাহকাটা আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-১৭) আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কিত নির্বাহী কমিটির সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলাম।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈঠকে আশ্রয়শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের পালানোর বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, বিভিন্ন পয়েন্টে তল্লাশিচৌকি স্থাপন করার। আশ্রয়শিবিরে মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তৎপরতা, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ খুনাখুনি বৃদ্ধির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ক্যাম্পের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়।
আশ্রয়শিবিরে মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান বন্ধ, মাঝিদের (রোহিঙ্গা নেতা) কার্যক্রম বৃদ্ধি ও তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড নজরদারিতে রাখার বিষয়ে সভায় আলোচনা হয়।