রেললাইন ফেটে গেলে, ভেঙে গেলে কিংবা কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে জরুরি একটি যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। সেই যন্ত্রের নাম রেল কাটিং মেশিন (রেললাইন কাটার যন্ত্র)। দীর্ঘদিন ধরে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জার্মানি থেকে যন্ত্রটি আমদানি করে। দেশে পৌঁছাতে যন্ত্রটির মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৭ লাখ টাকা। সম্প্রতি পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাবনার পাকশী বিভাগীয় এক প্রকৌশলী দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাত্র ২৭ হাজার টাকায় যন্ত্রটি তৈরি করেছেন। পরীক্ষামূলকভাবে যন্ত্রটি ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রাথমিক ব্যবহারে সফলতাও পাওয়া গেছে।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, পরীক্ষামূলক ব্যবহারের পর যন্ত্রটি টেকসই হলে দেশেই তৈরি করা হবে। এতে একদিকে আমদানিনির্ভরতা থাকবে না, অন্যদিকে অর্থ ও সময় সাশ্রয় হবে।
যন্ত্রটি তৈরি করেছেন প্রকৌশলী নাজিব কায়সার (৩৬)। তিনি রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে স্নাতক করেছেন। এরপর ৩৩তম বিসিএসে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ রেলওয়েতে সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ হিসেবে কর্মরত আছেন।
আলাপকালে প্রকৌশলী নাজিব কায়সার বলেন, রেল কাটিং মেশিন রেলওয়ের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি যন্ত্র। দীর্ঘদিন ধরে যন্ত্রটি জার্মানি থেকে আমদানি করা হচ্ছে। এতে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। ফলে তিনি দেশীয় প্রযুক্তিতে যন্ত্রটি তৈরির উদ্যোগ নেন। এরপর রেলওয়ের ঈশ্বরদী প্রকৌশল বিভাগের নিজস্ব ওয়ার্কশপে যন্ত্রটি তৈরির কাজ শুরু করেন। গত ৬ অক্টোবর কাজ শুরু করে প্রকৌশল বিভাগের কর্মীদের সহযোগিতায় মাত্র ১১ দিনে তিনি যন্ত্রটি তৈরি করেন। এরপর পরীক্ষামূলক ব্যবহারে সফল হন। তিনি আরও বলেন, যন্ত্রটি তৈরিতে একটি পেট্রল ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। যন্ত্রটিতে বিভিন্ন আকারে কাটিং ডিস্ক ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পরীক্ষামূলক ব্যবহারে দেখা গেছে, যন্ত্র দিয়ে মাত্র ১ মিনিট ২০ সেকেন্ডের মধ্যে রেললাইনকে দ্বিখণ্ডিত করা যাচ্ছে, যা আমদানি করা যন্ত্রের চেয়ে অনেক কম সময় লাগছে।
নাজিব কায়সার বলেন, ‘আমি দেশকে ভালোবাসি। দেশের টাকা দেশে থাক, সেটা চাই। আর এ চাওয়া থেকেই মেশিনটি তৈরি করেছি। ভবিষ্যতে একটি ড্রিল মেশিন তৈরির কাজ শুরু করেছি। যেটি আমদানিতে খরচ হয় প্রায় ১০ লাখ টাকা। আশা করছি, মাত্র ৫০ হাজার টাকায় মেশিনটি তৈরি করতে পারব। দুটি মেশিন দেশে তৈরি করা গেলে রেলওয়ের অনেক টাকা সাশ্রয় হবে।’

সম্প্রতি সরেজমিনে ঈশ্বরদী জংশন স্টেশনের পাশেই পরীক্ষামূলক রেল কাটার যন্ত্রটি ব্যবহার করতে দেখা যায়। রেল লাইনের শক্ত লোহার পাতে যন্ত্রটি আটকে হাতল টেনে যন্ত্রটি ব্যবহার করেন রেলওয়ের কর্মীরা। হাতল চেপে ধরতেই কেটে যাচ্ছে লোহার পাত।
জানতে চাইলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আবু জাফর বলেন, দেশের বিভিন্ন এলাকায় এখনো ব্রিটিশ আমলের পুরোনো রেললাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল করে। এসব লাইনের কোথাও ফাটল দেখা যায়, কোথাও ভেঙে যায়। ফলে লাইন মেরামতের জন্য কাটিং মেশিন খুব জরুরি হয়ে পড়ে। একসময় হেকসো ব্লেড দিয়ে লাইন কাটা হতো, এতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগত। পরবর্তী সময়ে জার্মানি থেকে কাটিং মেশিন আমদানি করা হলো। ওই মেশিনেও কয়েক মিনিট সময় লাগত। কিন্তু দেশে তৈরি মেশিনটি দিয়ে দ্রুত লাইন কাটা যাচ্ছে। এতে সময় সাশ্রয় হচ্ছে।
কম খরচে, দেশীয় প্রযুক্তি ও কারিগরি সহায়তায় রেল কাটিং মেশিন তৈরি হওয়ায় তাঁরা খুশি ও গর্বিত বলে জানান পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) লিয়াকত শরীফ খান। তাঁর ভাষ্য, ঈশ্বরদী রেলওয়ের কর্মচারীরা পরীক্ষামূলকভাবে কাটিং মেশিন দিয়ে কাজ করছেন। যদি মেশিনটি টেকসই হয়, তাহলে ঈশ্বরদী ওয়ার্কশপ থেকে সরকারি খরচে রেল কাটিং মেশিন তৈরি করা হবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) আফজাল হোসেন বলেন, পাকশী বিভাগীয় প্রকৌশলী নাজিব কায়সার যে মেশিন তৈরি করেছেন, তা নিঃসন্দেহে ভালো কাজ। তিনি প্রশংসার দাবিদার। যদি মাঠপর্যায়ে সফলভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়, টেকসই হয়, তাহলে সরকারি উদ্যোগে এই মেশিন তৈরি করে পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে ব্যবহার করা হবে।
সরোয়ার মোর্শেদ
পাবনা


















