দিয়াবাড়ির খালে কারা অস্ত্র ফেলেছিল, ৭ বছরেও জানাতে পারল না পুলিশ

0
110
২০১৬ সালের জুনে উত্তরার দিয়াবাড়ী এলাকার খাল থেকে উদ্ধার করা হয় বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ

২০১৬ সালের জুন মাসে তিন দফায় রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ির খাল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গুলি ও বিস্ফোরক উদ্ধার করেছিল ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এ ঘটনা দেশব্যাপী নানা আলোচনার জন্ম দেয়। পুলিশ কর্মকর্তারা তখন বলেছিলেন, কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী অস্ত্রগুলো সীমান্ত থেকে এনে তা রাখার নিরাপদ স্থান না পেয়ে খালে ফেলেছে। নাশকতার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এগুলো আনা হয়ে থাকতে পারে।

তবে সাত বছরেও এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ জোগাড় করতে না পেরে পুলিশ এখন বলছে, ওই সব অস্ত্র-গোলাবারুদ কারা, কী উদ্দেশ্যে এনেছিল, তা জানা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি উল্লেখ করে ওই ঘটনায় করা তিনটি জিডির (সাধারণ ডায়েরি) তদন্ত প্রতিবেদন শিগগিরই জমা দেওয়া হবে।

পরিত্যক্ত অবস্থায় ওই অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় তুরাগ থানায় তখন তিনটি পৃথক জিডি করা হয়েছিল। এসব জিডির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপকে। আলোচিত ওই ঘটনায় সাত বছরেও মামলা হয়নি।

অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের রহস্য উদ্‌ঘাটন করা যায়নি। কারা, কোথা থেকে, কী উদ্দেশ্যে এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ এনেছিল, তা জানা যায়নি। এসব তথ্য উল্লেখ করে তিনটি জিডির তদন্ত প্রতিবেদন শিগগিরই আদালতে দেওয়া হবে।

আহমেদুল ইসলাম, অতিরিক্ত উপকমিশনার, স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ (অস্ত্র ও ডগ স্কোয়াড), ডিএমপি

২০১৬ সালের ১৮ জুন প্রথম দফায় উত্তরার ১৬ নম্বর সেক্টরের দিয়াবাড়ি খাল থেকে কালো ৭টি ব্যাগের ভেতর থেকে ৯৫টি ৭.৬২ এমএম পিস্তল, ২টি ৯ এমএম পিস্তল, ৪৬২টি ম্যাগাজিন (২৬৩টি এসএমজির), ১ হাজার ৬০টি গুলি, ১০টি বেয়নেট, ১৮০টি ক্লিনিং রড ও ১০৪টি স্প্রিংযুক্ত বাক্স উদ্ধার করা হয়।

১৯ জুন দ্বিতীয় দফায় একই খাল থেকে আরও ৩টি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। ব্যাগে ছিল এসএমজির ৩২টি ম্যাগাজিন ও ৮টি ক্লিনিং রড।

২৫ জুন তৃতীয় দফায় একই এলাকার অন্য একটি খাল থেকে উদ্ধার করা হয় আরও ৩টি ব্যাগ, যেগুলোর মধ্যে ছিল ৫টি ওয়াকিটকি, ২টি ট্রান্সমিটার, ২টি ফিডার কেব্‌ল, ২২টি কৌটা (যার মধ্যে ছিল আইসি, ট্রানজিস্টর, ক্যাপাসিটর ও সার্কিট), ৭ প্যাকেট বিস্ফোরক জেল, ৪০টি পলিথিনের ব্যাগে থাকা বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস সরঞ্জাম এবং রুপালি ও সবুজ রঙের স্প্রিংযুক্ত ৩২৫টি বাক্স। এ ছাড়া আরও কিছু ইলেকট্রিকস ডিভাইস উদ্ধার করা হয়।

২০১৬ সালের ১৮ জুন বেলা ৩টার দিকে নম্বরবিহীন একটি কালো জিপ থেকে খালে ব্যাগ ফেলতে দেখে এক পুলিশ কনস্টেবল তুরাগ থানায় খবর দেন। ওই খবরের ভিত্তিতে টহল পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। এর আগে আগেই অবশ্য জিপটি সেখান থেকে পালিয়ে যায়।

১৮ জুন বেলা তিনটার দিকে নম্বরবিহীন একটি কালো জিপ থেকে খালে ব্যাগ ফেলতে দেখে এক পুলিশ কনস্টেবল তুরাগ থানায় খবর দেন। ওই খবরের ভিত্তিতে টহল পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। এর আগে আগেই অবশ্য জিপটি নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান চালক।

অবৈধ ওই অস্ত্র উদ্ধারের অভিযান শেষে তৎকালীন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বড় ধরনের নাশকতা ঘটাতেই অস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুত করা হয়েছিল। নাশকতার পরিকল্পনা পুলিশের অভিযানের কারণেই নস্যাৎ হয়ে গেছে বলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন।

২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি অবসরে গেছেন শহীদুল হক। এর আগে দিয়াবাড়ি খাল থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের পর দেড় বছর আইজিপি ছিলেন তিনি। সেই সময় ওই ঘটনার কোনো কিনারা হয়নি। গতকাল শনিবার এ নিয়ে জানতে চাওয়া হলে সাবেক এই আইজিপি বলেন, ‘সোর্স (সূত্র) শনাক্ত করা যায়নি। অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কারা ফেলে গেছে, তা পুলিশ বের করতে পারেনি। তখন বাসাবাড়িতেও অভিযান চালানো হয়েছিল। পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছিল বলে জিডি করা হয়েছিল। কারও পজিশনে পেলে ওই ঘটনায় মামলা করা যেত।’

পরিত্যক্ত অবস্থায় ওই অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় তুরাগ থানায় তখন তিনটি পৃথক জিডি করা হয়েছিল। এসব জিডির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপকে। আলোচিত ওই ঘটনায় সাত বছরেও মামলা হয়নি।

ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এটি কোনো সাধারণ অপরাধীর কাজ নয়। যারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশে অশান্তি সৃষ্টি করতে চায়, মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার বিষয়টি ভন্ডুল করতে চায়, এটা তাদের কাজ।’

গতকাল এ নিয়ে জানতে চাওয়া হলে ডিএমপির সাবেক এই কমিশনার বলেন, ‘সেই ছয় থেকে সাত বছর আগের কথা। অস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল। তবে আর্মসের (অস্ত্র) ধরন দেখে মনে হয়েছিল, এটা দেশের কোনো অপরাধীদের কাজ ছিল না। এ ধরনের অস্ত্র দেশীয় মাস্তান, সন্ত্রাসীরা ব্যবহার করে না। তাই ধরে নেওয়া হয়েছিল, এটা বড় কোনো দুর্বৃত্তদের কাজ।’

আছাদুজ্জামান মিয়া আরও বলেন, দেশের বাইরে পাচারের সময় চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার, মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক এবং বগুড়ায় আনারসের ট্রাকে অস্ত্র ধরা পড়েছিল। সেই অস্ত্রের সঙ্গে দিয়াবাড়ির অস্ত্রের মিল আছে। সে জন্য তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা হয়েছিল, এটা দুর্বৃত্তদের কাজ। যখন পুলিশের ধরপাকড় শুরু হলো, তখন দুর্বৃত্তরা নিরাপদ স্থান না পেয়ে এবং আইনি ঝামেলা এড়াতে দিয়াবাড়ির খালে এসব অস্ত্র ফেলে দেয়। এসবই অনুমাননির্ভর ধারণা ছিল। অস্ত্রগুলো কারা ফেলে গিয়েছিল, সে বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ বের করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা।

অস্ত্রের উৎস ও গন্তব্য জানতে তৎপরতা নেই পুলিশের

দিয়াবাড়ি খাল থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের বিষয়ে গত সপ্তাহে ডিএমপির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের কোনো সন্ত্রাসী দল সীমান্ত থেকে হয়তো অস্ত্রগুলো এনেছিল। নিরাপদ স্থান খুঁজে না পাওয়ায় এগুলো তারা কয়েক দফায় খালে ফেলে দেয়।

এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, উদ্ধার করা অস্ত্র ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যবহৃত। দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধরপাকড়ের কারণে এসব অস্ত্র রাখার নিরাপদ স্থান না পেয়ে হয়তো তারা দিয়াবাড়ি খালে ফেলে গেছে।

দিয়াবাড়িতে উদ্ধার করা অস্ত্র ও গোলাবারুদ অকেজো ছিল উল্লেখ করে স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের আরেক কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিদের কাছে এ পর্যন্ত যত অস্ত্র পাওয়া গেছে, তার বেশির ভাগই পাশের দেশ থেকে আনা।

অস্ত্র ও গোলা বারুদ উদ্ধারের ঘটনায় হওয়া তিনটি জিডি তদন্ত তদারকির দায়িত্বে আছেন ডিএমপির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের (অস্ত্র ও ডগ স্কোয়াড) অতিরিক্ত উপকমিশনার আহমেদুল ইসলাম। গত বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের রহস্য উদ্ঘাটন করা যায়নি। কারা, কোথা থেকে, কী উদ্দেশ্যে এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ এনেছিল, তা জানা যায়নি। এসব তথ্য উল্লেখ করে তিনটি জিডির তদন্ত প্রতিবেদন শিগগিরই আদালতে জমা দেওয়া হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.