দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ধারাবাহিক এ পতনের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কার মিল রয়েছে। পতন যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় এবং ১০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, তাহলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হবে। এ অবস্থায় আইএমএফের ঋণ সহায়তা নাও মিলতে পারে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থা সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান এমন মন্তব্য করেছেন।
গতকাল সোমবার রাজধানীর পল্টনে অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সংলাপে অধ্যাপক রেহমান সোবহান দেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে মত দেন। তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও দেন। ইআরএফ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ আলোচনার শিরোনাম ছিল– ‘অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সঙ্গে সংলাপ’। ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী বক্তব্য দেন সংগঠনের সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা।
রেহমান সোবহান বলেন, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের ওপর ভর করে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। এখন প্রকৃত রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। রিজার্ভের ধারাবাহিক পতন নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের নাজুক পরিস্থিতিতে পড়বে। এ ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ঋণ সহায়তা পাওয়াও কঠিন হবে।
রেহমান সোবহান অবশ্য মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি নিঃসন্দেহে শ্রীলঙ্কার চেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, আমাদের বড় একটি রপ্তানি খাত আছে। সেই সঙ্গে আছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়, যা শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক বেশি। সে কারণে তিনি বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কখনও শ্রীলঙ্কার মতো হবে না। রিজার্ভের পতনে সরকারের কোনো নীতির দায় আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তার সবকিছু জানা নেই। তবে দৃশ্যমান উদ্যোগগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দেখা গেছে।
রেহমান সোবহান বলেন, বর্তমানে অনেক অর্থনীতিবিদ ডলারের বিনিময় হার বাজার ব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে এটি বাস্তবায়ন করা সহজ হবে না। কারণ এতে করে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে, যা দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করতে পারে। তিনি বিনিময় হার পুরোপুরি বাজার ব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে নন। কারণ সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় সফল দেশ ভারত, চীনসহ অন্যান্য দেশও বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করে।
তিনি বলেন, রিজার্ভ ধরে রাখতে এরই মধ্যে কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়ানোর পাশাপাশি বিলাসী পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করা হলেও তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, এ সংকটময় পরিস্থিতিতেও বিএমডব্লিউ গাড়ি আমদানি হচ্ছে। নীতিনির্ধারকদের এই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আগে বিএমডব্লিউ গাড়ি আমদানি করা হবে– নাকি ডিম, সার কিংবা সুতা আমদানি করবে। দেশের চলমান ডলার সংকট নিরসনে বিলাসী পণ্যের পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেন তিনি।
রেহমান সোবহান বলেন, প্রচুর পরিমাণে লোক দেশের বাইরে গেলেও রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় কমে যাচ্ছে। তবে তার মানে এই নয় যে, দেশে প্রবাসী আয় আসা বাস্তবে কমে গেছে। আনুষ্ঠানিক পথে না এসে অনানুষ্ঠানিক পথে আসছে, যার মাধ্যম হুন্ডি। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশে না এসে দেশের বাইরে থাকছে। যারা বিদেশে অর্থ পাচার করে, তাদের জন্য যা সুবিধাজনক।
তাঁর মতে, দেশের আর্থিক খাতের সংস্কৃতিতে বড় পরিবর্তন এসেছে। ঋণ নেওয়ার পর ফেরত না দেওয়া নিয়মে পরিণত হয়েছে। যারা এসব করছেন, তারা নিজেদের ব্যবসায়ী নন, বড় রাজনীতিক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। এমনকি ঋণখেলাপিদের অংশ নিতে দেওয়া হবে না, প্রতিটি নির্বাচনের আগে এমন ঘোষণা দেওয়া হলেও পরে ছাড় দেওয়ার সংস্কৃতি চালু হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিছু ব্যবসায়ী ঋণ নেন পরিশোধ না করার জন্য। এদের বারবার পুনঃতপশিল ও অবলোপন সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু ছোট ঋণগ্রহীতারা এমন সুবিধা পান না। যথাযথ আইনি পদক্ষেপ না নেওয়ায় ঋণখেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।
রেহমান সোবহান বলেন, বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ সময়োপযোগী ছিল। কিন্তু সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব ছিল। এ ক্ষেত্রে সব ধরনের ঝুঁকি সরকারের আর লভ্যাংশ বেসরকারি খাতের। এমনকি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদনে না থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। এতে যেসব উদ্যোক্তা কোনোভাবেই এ খাতসংশ্লিষ্ট নন, তারাও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে। তা ছাড়া বিদ্যুতে অবকাঠামোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সঞ্চালন লাইন গড়ে ওঠেনি। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। ১০ বছরের মাথায় বেসরকারিভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মডেল পর্যালোচনা করার দরকার ছিল। কিন্তু তা না করায় এখন এ খাতের বাড়তি ক্যাপাসিটি চার্জ সরকারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ইউক্রেনে যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও পড়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে যাদের সম্পর্ক, তাদের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে মালপত্র নিয়ে একটি জাহাজ এলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় জাহাজটি ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। খুব বেশি না হলেও রপ্তানিতেও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব রয়েছে।