রাহুলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী

0
202
রাহুল গান্ধী।

ভারত তথা উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম রাহুল গান্ধীর। তাঁর বাবা রাজীব গান্ধী, দাদি ইন্দিরা গান্ধী এবং প্রমাতামহ জওহরলাল নেহরু ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তাদের রাজনৈতিক উত্তরসূরি রাহুলও দেশটির সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন হবেন, এমনটাই মনে করা হতো এক সময়। সাম্প্রতিক সময়ে সেই সম্ভাবনা অনেকটা ফিকে হয়ে আসছিল, তবে তা অসম্ভব মনে হয়নি কারও। এর মধ্যেই তাঁকে আদালতে দণ্ডিত এবং লোকসভায় অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন পথে এগোচ্ছে, তা নিয়ে হিসাবনিকাশ শুরু হয়েছে।

নিম্ন আদালতের রায় বহাল থাকলে ভারতের জনপ্রতিনিধি আইন অনুযায়ী মোট ৮ বছর ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি রাহুল। দুই বছর জেলে কাটানোর পরও ৬ বছরের জন্য ভোটে লড়তে পারবেন না। অর্থাৎ ২০৩১ সালের আগে নির্বাচনে লড়তে পারবেন না তিনি। ততদিনে তাঁর বয়সও হবে প্রায় ৬০ বছর। বতর্মানে ৫২।

আদালতে লড়াইয়ের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক জীবন মসৃণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতে ক্রমক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্র এবং বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হওয়ায় উচ্চ আদালত কী সিদ্ধান্ত দেবেন, তা নিয়ে পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন। অবশ্য অনেক গুরুতর মামলায়ও দেশটির সাংসদদের সাজা স্থগিত করার নজির আছে উচ্চ আদালতের।

অবশ্য বিজেপি রাহুলকে এতো সহজে ছাড়বে বলে মনে হয় না। তাঁর বিরুদ্ধে আরও দুটি মানহানি এবং একটি অর্থ পাচারের মামলা ঝুলছে। এর মধ্যে একটি হলো ভারতের জাতির পিতা হিসেবে খ্যাত মহাত্মা গান্ধীকে হত্যায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে (আরএসএস) দায়ী করে দেওয়া বক্তৃতার বিরুদ্ধে মামলা। ২০১৪ সালে কংগ্রেস নেতা অভিযোগ করেছিলেন, আরএসএসের লোকেরা মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, লোকসভায় রাহুল গান্ধীর অযোগ্যতা শেষ পর্যন্ত আশীর্বাদ হতে পারে। এটা তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট হওয়াও অসম্ভব নয়। ভারতের অনেক শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক বিভিন্ন সময় মামলায় দণ্ডিত হলেও রাহুলের ঘটনাটি ভিন্নতর। তিনি দুর্নীতি বা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের মামলায় দণ্ডিত হননি। এ মামলাটির সঙ্গে বাকস্বাধীনতার সম্পর্ক রয়েছে। ফলে তাঁকে অপরাধী হিসেবে প্রমাণ করতে পারবে না বিজেপি সরকার। অন্যদিকে রাহুলের সাজার ঘটনায় বিজেপির কুমতলব দেখছেন দেশটির বিরোধীরা। তারা এ রায়ের কড়া সমালোচনা করছেন।

আগামী বছর দেশটির সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাহুলের বিরুদ্ধে আদালত ও সংসদের সিদ্ধান্ত এলো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মোদি সরকারের সমালোচনাকারী বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা গত মাসে আম আদমি পার্টির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করেছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় কর কর্তৃপক্ষ বিবিসির স্থানীয় অফিসে অভিযান চালায়।

কোন পথে ফিরতে পারেন রাহুল : নিম্ন আদালতে ১০ বছর জেলের সাজাপ্রাপ্ত লক্ষদ্বীপের সাংসদ মোহম্মদ ফয়জলকে বরখাস্ত করেছিলেন লোকসভার স্পিকার। দু’মাস আগে খুনের চেষ্টার অপরাধে ১০ বছর দণ্ড হয় তাঁর। কেরল হাইকোর্ট তাঁর সদস্যপদ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য লোকসভা সচিবালয়কে নির্দেশ দেন। তবে নির্দেশের পরেও এখনও পর্যন্ত ফয়জলকে সাংসদ পদে ফেরানো হয়নি।

উচ্চতর আদালত রাহুলের বিরুদ্ধে সুরাত জেলা আদালতের সামগ্রিক রায়ের (দোষী ঘোষণা এবং ২ বছরের জেলের সাজা) ওপর স্থগিতাদেশ এবং কেরল হাই কোর্টের মতো নির্দেশিকা জারি করলে রাহুলের পক্ষেও সাংসদ পদ ফিরে পাওয়া সম্ভব। তবে গতকাল শুক্রবার সরকারপক্ষের নজিরবিহীন তৎপরতা দেখে বিরোধী নেতারা মনে করছেন, দ্রুত রাহুলের আসনে উপনির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করা হতে পারে। অবশ্য উচ্চ আদালত মনে করলে সেই প্রক্রিয়ার ওপরেও স্থগিতাদেশ দিতে পারেন।

ফয়জল বলেছেন, ‘আমার ক্ষেত্রে কেরল হাইকোর্ট সদস্যপদ ফেরানোর নির্দেশ দিয়েছেন। রাহুলের ক্ষেত্রেও তেমন হতেই পারে।’ অতীতে স্পিকারের সিদ্ধান্ত খারিজ করে বিধায়কের সদস্যপদ ফেরানোর নজির রেখেছেন সুপ্রিম কোর্ট। দেড় দশক আগে কর্ণাটক বিধানসভার স্পিকার তথা বিজেপি নেতা কেজি বোপাইয়া একাধিক বিরোধী বিধায়কের পদ খারিজ করেছিলেন। কিন্তু শীর্ষ আদালতের নির্দেশে তাঁরা পদ ফিরে পান।

২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরে আরজেডির প্রধান লালু প্রসাদ যাদব লোকসভা থেকে অযোগ্য হয়েছিলেন। এআইএডিএমকে প্রধান জয়ললিতাকে অবৈধ সম্পদের মামলায় চার বছরের কারাদণ্ডের পর সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে তামিলনাড়ু বিধানসভা থেকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল। তিনি তখন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। রায়ের পর তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত উচ্চ আদালতেও বহাল ছিল।

এ অবস্থায় রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে ভারতের সাবেক সংসদ সদস্য ও সিপিআইএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, এখনই কিছু বলা ঠিক হবে না। উচ্চ আদালতের রায়ের দিকে আমাদের তাকিয়ে থাকতে হবে। রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে রাজ্যসভা থেকে জিতে আসতে পারেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন উচ্চ আদালত সাজার মেয়াদ না কমালে বা সাজার ওপর স্থগিতাদেশ জারি না করলে কোনো নির্বাচনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না তিনি।

কংগ্রেস পার্টির নেতা জয়রাম রমেশ গুজরাটের আদালতের রায়কে ‘গুরুতর রাজনৈতিক সমস্যা’ বলে অভিহিত করে বলেছেন– এটা ‘আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করতে পারে।’ কংগ্রেসের সাবেক নেতা ও দেশটির সাবেক আইনমন্ত্রী কপিল সিবাল আদালতের সিদ্ধান্তকে ‘উদ্ভট’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন রাহুলের মন্তব্য ‘একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে’ কোনো সম্প্রদায়কে কটাক্ষ করে নয়।

তবে রাহুল কিন্তু ভেঙে পড়েননি। লোকসভার সিদ্ধান্তের পর তিনি টুইটে লিখেছেন, ‘আমি ভারতের কণ্ঠস্বর রক্ষার জন্য লড়াই করছি। এজন্য আমি যে কোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.