রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী টানা দুইবারের বেশি নয়

0
191
রাজধানীর একটি হোটেলে আজ বিএনপির ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ তুলে ধরেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন

আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছে বিএনপি। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়লাভের পর বর্তমান ‘ফ্যাসিস্ট’ সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ সরকার বর্তমান ‘কর্তৃত্ববাদী’ সরকারের আমলে ‘ভেঙে পড়া’ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর রূপান্তরমূলক সংস্কারকাজগুলো গ্রহণ করবে বলে জানিয়েছে দলটি। একই সঙ্গে বিএনপি রূপকল্পে পরপর দুইবারের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন না করার নিয়ম চালুর কথা বলেছে। এতে আরও বলা হয়, রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনতে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে। এ ছাড়া ভারসাম্য আনা হবে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতার। বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে ‘উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা’ প্রবর্তন করা হবে। নানাবিধ সংস্কারের জন্য কমিশন গঠনসহ সংবিধানে গণভোট ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের।

গতকাল সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বহুল আলোচিত এ রূপরেখা ঘোষণা করে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। রূপরেখায় প্রতিহিংসা ও প্রতিরোধের রাজনীতির বিপরীতে অন্তর্ভুক্তিমূলক রেইনবো নেশন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথাও বলেছে। এমনকি শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা এবং চাকরিতে প্রবেশের বয়সমীমা বৃদ্ধিরও ঘোষণা দিয়েছে প্রায় দেড় দশক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি।
সংবাদ সম্মেলনে দলের পক্ষে জাতীয় স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বিস্তারিত রূপরেখা উপস্থাপন করেন। এর আগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংবাদ সম্মেলনে যুক্ত হয়ে রূপরেখার সারমর্ম তুলে ধরেন। এ সময় বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ সিনিয়র নেতা, সমমনা গণতন্ত্র মঞ্চ ও ২০ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতৃবৃন্দ, দল সমর্থক বিশিষ্ট নাগরিক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অবশ্য সংবাদ সম্মেলনে কোনো প্রশ্ন গ্রহণ করা হয়নি।
রূপরেখায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল, সেই রাষ্ট্রের মালিকানা আজ তাদের হাতে নেই। বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার রাষ্ট্র কাঠামোকে ভেঙে চুরমার করে ফেলছে। এ রাষ্ট্রকে মেরামত ও পুনর্গঠন করতে হবে। জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হবে।

এতে আরও বলা হয়, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ঘোষিত ১৯ দফা এবং দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঘোষিত ‘ভিশন-২০৩০’ এর আলোকে এ রূপরেখা প্রস্তুত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে যথাসময়ে অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক সংস্কার প্রস্তাব ও উন্নয়ন কর্মসূচি প্রকাশ করা হবে। রাষ্ট্র কাঠামো ‘মেরামতে’ এটি অধিকতর সমৃদ্ধ করতে গঠনমূলক পরামর্শ জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে তারা সাদরে গ্রহণ করবে।
গত আগস্ট থেকে এ রূপরেখা প্রণয়নে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা সংলাপ করেছে বিএনপি; যা গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হলো।

রূপরেখায় আরও যা থাকছে : ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গঠন করে বর্তমান ‘অবৈধ’ আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক গৃহীত সব অযৌক্তিক, বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনগুলো বাতিল/সংশোধন করার ঘোষণাও দিয়েছে বিএনপি। সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে। বর্তমান ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ সংশোধন করা হবে। সব রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন করা হবে। শুনানির মাধ্যমে সংসদীয় কমিটির ভেটিং সাপেক্ষে এসব প্রতিষ্ঠানের সাংবিধানিক ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হবে।

বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা বলেছে দলটি। বর্তমান বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য একটি ‘জুডিশিয়াল কমিশন’ গঠন করা হবে। একটি ‘প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন’ গঠন করে প্রশাসন পুনর্গঠন করা হবে। মিডিয়ার সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে একটি ‘মিডিয়া কমিশন’ গঠন করা হবে। দুর্নীতির ক্ষেত্রে কোনো আপস করা হবে না। অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে। সংবিধান অনুযায়ী ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগ করা হবে।

সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথাও রয়েছে বিএনপি রূপকল্পে। এ ক্ষেত্রে ইউনিভার্সাল হিউম্যান রাইটস চার্টার অনুযায়ী মানবাধিকার বাস্তবায়ন করবে। বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে একটি ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন’ গঠন করা হবে।

‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’- এ মূলনীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক ধর্মাবলম্ব্বী নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার ভোগ করার অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেছে তিনবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা বিএনপি। মুদ্রানীতির আলোকে শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ খাতে দায়মুক্তি আইনসহ সব কালাকানুন বাতিল করা হবে। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হবে। বিদেশবিষয়ক প্রশ্নে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যে কোনো প্রকার সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত করা হবে না বলে সাফ জানিয়েছে রাজপথের প্রধান বিরোধী দলটি। একই সঙ্গে কোনো সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না বলেও জানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদকে রাজনৈতিক ঢাল বা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এবং সন্ত্রাসবাদের তকমা লাগিয়ে ভিন্নমতের বিরোধী শক্তি এবং রাজনৈতিক বিরোধী দল দমনের অপতৎপরতার অভিযোগে এনেছে তারা। তারা বলেছে, এগুলো বন্ধ করা হলে প্রকৃত সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করা এবং আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করা সম্ভব হবে।

দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর স্বাধীন, শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান করার কথাও বলেছে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হবে এবং তাঁদের যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান করা হবে। যুবসমাজের ভিশন, চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব-উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। একই সঙ্গে এক বছরব্যাপী অথবা কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত, যেটাই আগে হবে, শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা প্রদান করা হবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি বিবেচনার কথা বলেছে।

এ ছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণের কথা রয়েছে রূপরেখায়। বলেছে, জাতীয় সংসদে মনোনয়নের ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে নারীদের প্রাধান্য দেওয়া হবে। চাহিদাভিত্তিক ও জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। সবার জন্য স্বাস্থ্য- এই নীতির ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের এনএইচএসের আদলে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির।

এ সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, শাহজাহান ওমর, বরকত উল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, শামসুজ্জামান দুদু, জয়নাল আবেদীন, আহমেদ আজম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আমান উল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, গোলাম আকবর খন্দকার, হাবিবুর রহমান হাবিব, জয়নুল আবদিন ফারুক, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সমমনা রাজনৈতিক দলের মধ্যে নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, গণফোরামের মোস্তফা মোহসীন মন্টু, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও সুব্রত চৌধুরী, গণঅধিকার পরিষদের রেজা কিবরিয়া, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, জেএসডির কামাল উদ্দিন পাটোয়ারী, কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

পেশাজীবীদের মধ্যে অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, অধ্যাপক সদরুল আমিন, অধ্যাপক আ ফ ম ইউসুফ হায়দার, অধ্যাপক তাজমেরী এস এ ইসলাম, অধ্যাপক এ কে এম আজিজুল ইসলাম, অধ্যাপক এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম, অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া, এম আবদুল্লাহ, কামাল উদ্দিন সবুজ, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও কাদের গণি চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.