রাশিয়া থেকে ভারতের জ্বালানি আমদানির পেছনে এশিয়ার শীর্ষ ধনী ব্যক্তি

0
26
রিলায়েন্সের মালিক মুকেশ আম্বানি, ছবি: রয়টার্স

রাশিয়ার তেল আমদানি ঘিরে ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। এ নিয়ে আল-জাজিরায় প্রতিবেদন করেছেন মেঘা বাহরি। আজ শুক্রবার অনলাইনে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানির কারণে ‘জরিমানা’ হিসেবে ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন। তাঁর দাবি, এভাবে ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে রাশিয়াকে সাহায্য করছে ভারত। এতে ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি শুল্ক আরোপিত দেশগুলোর তালিকায় উঠে এসেছে।

ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ক পুরোনো। স্নায়ুযুদ্ধ থেকেই দুই দেশ কৌশলগতভাবে ঘনিষ্ঠ। ভারতের অন্যতম প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হচ্ছে রাশিয়া। তবে রাশিয়া থেকে সম্প্রতি তেল আমদানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধিকে ঘিরে ভারতের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন ট্রাম্প।

ট্রাম্প ৩০ জুলাই নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছিলেন, ‘যখন সবাই চাইছে রাশিয়া যেন ইউক্রেনে হত্যা বন্ধ করে, তখন ভারত ও চীন রাশিয়ার তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। এটি মোটেও ভালো কিছু নয়।’

১৯ আগস্ট মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট সিএনবিসিকে বলেন, ‘ভারতের সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলোই রাশিয়ার এই তেল আমদানির বড় সুবিধাভোগী।’

রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ ও আম্বানি

ভারতে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক হলো রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মুকেশ আম্বানি।

আমস্টারডামের সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে রিলায়েন্সের মালিকানাধীন গুজরাটের জামনগর শোধনাগারে মোট অপরিশোধিত তেলের মাত্র ৩ শতাংশ এসেছিল রাশিয়া থেকে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ২০২৫ সালে তা গড়ে ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে।

২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসে জামনগর শোধনাগারে রাশিয়া থেকে ১ কোটি ৮৩ লাখ টন আমদানির অপরিশোধিত তেল এসেছে। এই পরিমাণ গত বছরের তুলনায় ৬৪ শতাংশ বেশি। এর বাজারমূল্য ৮৭০ কোটি ডলার। এই সাত মাসেই রিলায়েন্সের রাশিয়া থেকে আমদানির পরিমাণ ২০২৪ সালের মোট আমদানির তুলনায় মাত্র ১২ শতাংশ কম।

তেলের দাম কমানো ও ছায়া বহর

সিআরইএর ইউরোপীয় ইউনিয়ন-রাশিয়ার বিশ্লেষক বৈভব রঘুনন্দন আল-জাজিরাকে বলেন, এই পরিবর্তন এসেছে ২০২৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি চালু হওয়া রাশিয়ার তেলের মূল্যসীমার কারণে।

রঘুনন্দন বলেন, ‘মূল্যসীমা বসানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ার আয় কমানো। একই সঙ্গে বিশ্বে তেলের সরবরাহ নিশ্চিত রাখা। কম মূল্যসীমা হলে তেল ভারত ও চীনের মতো দেশের জন্য আরও আকর্ষণীয় হয়। কিন্তু এতে রাশিয়ার আয় সীমিত থাকে।’

রিলায়েন্সের কাছে এসব বিষয়ে আল-জাজিরার পক্ষ থেকে কয়েকটি প্রশ্ন পাঠানো হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

তবে মূল্যসীমা তিন বছর ধরে ৬০ ডলারে আটকে আছে এবং তা যথাযথভাবে কার্যকর হয়নি। ফলে এর প্রভাব কমে গেছে। উল্টো রাশিয়া শত শত জাহাজের একটি ‘ছায়া পরিবহন বহর’ তৈরি করেছে, যাতে তেল রপ্তানির সময় নিয়ম এড়ানো যায় এবং প্রকাশ্যে উল্লেখিত দামের চেয়ে বেশি দাম পাওয়া যায়। সিআরইএ জানায়, জানুয়ারি পর্যন্ত রাশিয়ার ৮৩ শতাংশ তেল এই ছায়া পরিবহন বহরের মাধ্যমে পাঠানো হতো। গত জুনে এই পরিবহন নেমে ৫৯ শতাংশে দাঁড়ায়।

২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসে জামনগর শোধনাগারে রাশিয়া থেকে ১ কোটি ৮৩ লাখ টন আমদানির অপরিশোধিত তেল এসেছে। এই পরিমাণ গত বছরের তুলনায় ৬৪ শতাংশ বেশি। এর বাজারমূল্য ৮৭০ কোটি ডলার। এই সাত মাসেই রিলায়েন্সের রাশিয়া থেকে আমদানির পরিমাণ ২০২৪ সালের মোট আমদানির তুলনায় মাত্র ১২ শতাংশ কম।

সিআরইএ রিলায়েন্সের আমদানি ও রপ্তানির তথ্য বিশ্লেষণ করে জানায়, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত গুজরাটের জামনগর শোধনাগার বিশ্বব্যাপী ৮ হাজার ৫০৯ কোটি ডলারের পরিশোধিত তেল রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৪২ শতাংশ (৩ হাজার ৬০০ কোটি) রপ্তানি হয়েছে সেই দেশগুলোতে, যারা রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

মোট রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশ গেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (১ হাজার ৭০০ কোটি ইউরো বা ১ হাজার ৯০৭ কোটি মার্কিন ডলার)। যুক্তরাষ্ট্রে গেছে ৬৩০ কোটি ডলারের তেলজাত পণ্য। এই অর্থের অন্তত ২৩০ কোটি ডলার এসেছে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল থেকে।

সর্বোচ্চ দামের দিক থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরের পর জামনগরের চতুর্থ ক্রেতার অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে পরিমাণের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বড় আমদানিকারক। ২০২৩ সালের মূল্যসীমা কার্যকর হওয়ার পর থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ৮৪ লাখ টন তেলজাত পণ্য আমদানি করেছে।

২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র জামনগর থেকে ১৪০ কোটি ডলারের জ্বালানি পণ্য আমদানি করেছে। গত বছরের তুলনায় এই হার ১৪ শতাংশ বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির মধ্যে আছে ব্লেন্ডিং কম্পোনেন্টস (৬৪ শতাংশ), পেট্রল (১৪ শতাংশ) ও ফুয়েল অয়েল (১৩ শতাংশ)।

মুকেশের মালিকানাধীন গুজরাটের জামনগর পরিশোধন কেন্দ্র
মুকেশের মালিকানাধীন গুজরাটের জামনগর পরিশোধন কেন্দ্র

নায়ারা এনার্জির ভূমিকা

রিলায়েন্সের পরেই রয়েছে নায়ারা এনার্জি। এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানার বড় অংশ রুশ কোম্পানিগুলোর। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় বড় জ্বালানি সংস্থা রসনেফটও রয়েছে। গুজরাটের বাদিনার শোধনাগার। এটি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম বেসরকারি জ্বালানি তেল শোধনাগার। এ বছর তাদের মোট অপরিশোধিত তেলের গড়ে ৬৬ শতাংশই রাশিয়া থেকে এসেছে। তবে পরিমাণের দিক থেকে নায়ারার আমদানি রিলায়েন্সের এক-তৃতীয়াংশ।

বিশ্লেষকদের মতে, শুধু রিলায়েন্সকে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বলে ভারতকে বাড়তি শুল্কের বোঝা বইতে হচ্ছে—এমনটা ভাবা ভুল।

অর্থনীতিবিদ র‍্যাচেল জিয়েম্বা বলেন, রাশিয়া থেকে সস্তা তেল আমদানির কারণে ভারতের বৈদেশিক ঘাটতি কমেছে। একই সঙ্গে বিশ্বকে ভারত দেখাতে পেরেছে যে তারা নিরপেক্ষ অবস্থানে আছে। তাই সরকারও এই বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার সুবিধা দেখছে।

ভারত ঐতিহাসিকভাবেই বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক জোট বাঁধেনি, এমনকি স্নায়ুযুদ্ধের সময়েও নয়।

ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম বেসরকারি জ্বালানি তেল শোধনাগার নায়ারা। এ বছর তাদের মোট অপরিশোধিত তেলের গড়ে ৬৬ শতাংশই রাশিয়া থেকে এসেছে। তবে পরিমাণের দিক থেকে নায়ারার আমদানি রিলায়েন্সের এক-তৃতীয়াংশ।

গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব আল-জাজিরাকে বলেন, রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি কেনার কারণে ভারতের ওপর ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ ‘পুরোটাই ভাঁওতা’।

অজয়ের ভাষায়, চীনই রাশিয়ার তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। অথচ তাদের কিছু বলা হয়নি। ট্রাম্প আসলে চীনকে নিয়ে ভয় পান। কাল যদি ট্রাম্প আর পুতিন ইউক্রেন নিয়ে কোনো সমঝোতায় পৌঁছান, তবে যুক্তরাষ্ট্র অন্য অজুহাতে ভারতের ওপর শুল্ক বসাবে। কারণ, এই শুল্ক আসলে অন্য বিষয় থেকে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক দাবিগুলো ভারত মেনে না নেওয়ায় ট্রাম্পের মধ্যে একধরনের হতাশা আছে।

শ্রীবাস্তব বলেন, রিলায়েন্স হয়তো কম দামে রাশিয়ার তেল কিনে লাভ করেছে। আর এটিকে আলোচনায় আনা হচ্ছে শুধু এ জন্য যে এটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ধনীদের নিয়েই সাধারণত প্রশ্ন তোলা হয়।

ভবিষ্যতের পরিবর্তন

মূল্যসীমা কার্যকর হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যেসব তেলজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে, তার ৩৮ শতাংশ ব্লেন্ডিং কম্পোনেন্টস, ৪ শতাংশ জেট ফুয়েল এবং ২ শতাংশ পেট্রল জামনগর তেল শোধনাগার থেকে সে দেশে গেছে।

সিআরইএর বিশ্লেষক রঘুনন্দনের ধারণা, বড় পরিবর্তন আসতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রাশিয়ার তেল থেকে প্রক্রিয়াজাত কোনো তেলজাত পণ্য তারা আর আমদানি করবে না। এটি ‘একটি বড় নীতিগত পরিবর্তন’। যদি এটি কঠোরভাবে কার্যকর হয়, তবে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।

রিলায়েন্সের অর্ধেকের বেশি জেট ফুয়েল রপ্তানি হয়েছে ইউরোপে। তাই এই বাজার হারালে তাদের কিছু পণ্যে বড় ক্ষতি হবে এবং সামগ্রিকভাবে রপ্তানি কৌশল নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

তবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে রিলায়েন্স রসনেফটের সঙ্গে ১০ বছরের একটি চুক্তিও করেছে। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে এই চুক্তি কীভাবে কার্যকর হবে, সেটি এখনো পরিষ্কার নয়।

আল জাজিরা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.