রাশিয়া থেকে গম আমদানি: বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের ওপর ইইউর নিষেধাজ্ঞা চাওয়ার পরিকল্পনা ইউক্রেনের

0
10
ক্রেনের সহায়তায় জাহাজে গম বোঝাই করা হচ্ছে, ফাইল ছবি–রয়টার্স

রাশিয়া অধিকৃত ইউক্রেনের ভূখণ্ডে উৎপাদিত গম আমদানি করা বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কাছে নিষেধাজ্ঞা আরোপের অনুরোধ জানানোর চিন্তা করছে ইউক্রেন। এ বিষয়ে ঢাকাকে সতর্ক করার পরও আমদানি অব্যাহত থাকায় এ চিন্তা করছে দেশটি।

দক্ষিণ এশিয়ায় কর্মরত ইউক্রেনের একজন কূটনীতিকের বরাতে এ খবর দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স।

ইউক্রেনের দিল্লি দূতাবাস থেকে ঢাকায় পররাষ্ট্র ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানোর বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাশিয়া থেকে সরকারি খাতের তুলনায় বেসরকারি খাতে অনেক বেশি গম আমদানি করা হয়। তবে বাংলাদেশ সাধারণত ‘অনিয়মিত’ কোনো উৎস থেকে গম আমদানি করে না।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে বিশাল কৃষি এলাকা দখলে রেখেছে। সেখান থেকে উৎপাদিত গম রাশিয়া চুরি করছে বলে অভিযোগ তুলেছে কিয়েভ। তবে রাশিয়ার শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা বলছেন, গম বা কৃষিপণ্য চুরির কোনো ঘটনায় তারা জড়িত নয়। কারণ, যে ভূখণ্ড একসময় ইউক্রেনের অংশ বলে বিবেচিত হতো, সেটি এখন রাশিয়ার অংশ এবং চিরকাল তা–ই থাকবে।

পুরো বিষয়টি সম্পর্কে জানেন এমন কর্মকর্তারা রয়টার্সকে কিছু নথি সরবরাহ করেছে। এসব নথির তথ্য অনুযায়ী, এ বছর নয়াদিল্লিতে অবস্থিত ইউক্রেন দূতাবাস থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কয়েকটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। এসব চিঠিতে ইউক্রেন থেকে কথিত ‘চুরি করা’ ও রাশিয়ার সমুদ্রবন্দর কাভকাজ থেকে বোঝাই করা দেড় লাখ টন গম না কেনার অনুরোধ করা হয়েছে।

গোপনীয় এ চিঠির বিষয়ে ভারতে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ওলেকসান্দার পলিসচুক বলেন, চিঠির বিষয়ে ঢাকা থেকে তাঁরা কোনো সাড়া পাননি। কিয়েভ এ বিষয়ে আরও তৎপর হবে এমনটা জানিয়ে তিনি বলেন, তাঁদের গোয়েন্দা তথ্য বলছে, জাহাজে বোঝাইয়ের আগে রাশিয়া অধিকৃত ইউক্রেন অঞ্চলের গমের সঙ্গে রাশিয়ায় উৎপাদিত গম মিশিয়ে দিচ্ছে।

নয়াদিল্লিতে ইউক্রেনের দূতাবাসে রয়টার্সকে এক সাক্ষাৎকারে পলিসচুক বলেন, ‘এটা অপরাধ’।

ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমরা আমাদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহকর্মীদের সঙ্গে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিনিময় করে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে তাদের প্রতি আহ্বান জানাব।’

ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশের এমন কূটনৈতিক টানাপোড়েনের ঘটনা আগে কখনো শোনা যায়নি। বাংলাদেশ ও রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেউ–ই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

বাংলাদেশের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, ‘গমের উৎস যদি ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড হয়, তাহলে আমরা সেটা আমদানি করি না। বাংলাদেশ কোন “চোরা গম” আমদানি করে না।’

রাশিয়ার সঙ্গে চলমান যুদ্ধের মধ্যে ইউক্রেনের রপ্তানি আয়ের বড় একটি অংশ আসে কৃষি খাত থেকে। এ বছরের এপ্রিলে ‘চোরা গমের’ বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগে ইউক্রেন তার সমুদ্রসীমা থেকে একটি বিদেশি জাহাজ আটক করে। এ ছাড়া গত বছর একই অভিযোগে আরও একটি বিদেশি কার্গো জাহাজ জব্দ ও ক্যাপ্টেনকে আটক করা হয়।

পশ্চিমাদের দেওয়া নিষেধাজ্ঞাকে ফাঁকি দিয়ে তেল, শস্য ও অস্ত্র রপ্তানি করতে প্রস্তুত করা রাশিয়ার ছায়া জাহাজ বহরের ৩৪২টির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এসব নিষেধাজ্ঞাকে অবৈধ বলছে রাশিয়া।

ইউক্রেনের এক কর্মকর্তা বলছেন, ইউক্রেনের আইনে রাশিয়ার শস্য উৎপাদনকারীদের সঙ্গে যেকোনো ধরনের স্বেচ্ছাবাণিজ্য নিষিদ্ধ। অবশ্য রাশিয়া এই নিষেধাজ্ঞাকে অবৈধ বলছে।

ভারতে অবস্থিত ইউক্রেনের দূতাবাস থেকে পাঠানো চারটি চিঠি পর্যালোচনা করেছে রয়টার্স। এসব চিঠিতে রাশিয়ার অধিকৃত ক্রিমিয়া, কার্চ ও বার্দিয়ানাস্ক বন্দর থেকে রাশিয়ার কাভকাজ বন্দরে গম বহনকারী জাহাজের নাম, নিবন্ধন নম্বর সরবরাহ করা হয়েছিল।

গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জুনের মধ্যে পাঠানো ওসব চিঠিতে জাহাজগুলোর রাশিয়ার কাভকাজ সমুদ্রবন্দর ছেড়ে যাওয়া ও বাংলাদেশে পৌছানোর সম্ভাব্য তারিখও জানানো হয়েছিল।

চিঠিতে বলা হয়েছে, এ ধরনের আমদানির কারণে বাংলাদেশ নিষেধাজ্ঞার মতো মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে এবং এ ধরনের ক্রয় মানবিক সংকটকে ত্বরান্বিত করবে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘নিষেধাজ্ঞার আওতা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের বাইরেও বিস্তৃত হতে পারে। এতে এমন সরকারি কর্মকর্তা ও সংস্থাও অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, যারা এসব লেনদেনের অনুমোদন দেন বা তা বরদাশত করেন।

ইইউর পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তানীতির মুখপাত্র আনিত্তা হিপার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ইউক্রেন কর্তৃপক্ষের পাঠানো জাহাজগুলো আপাতত ইইউর নিষেধাজ্ঞার আওতায় নেই। তবে ইউক্রেনের খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত করার ক্ষেত্রে যেসব কার্যক্রম সহায়ক বা দায়ী বলে প্রমাণিত হবে, তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।

রয়টার্সের হিসাব অনুযায়ী ক্রিমিয়া ছাড়া রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলো ২০২৪ সালে দেশটির মোট গম উৎপাদনের প্রায় ৩ শতাংশ জোগান দিয়েছে। রুশ পরিবহন সংস্থা রুসঅ্যাগ্রোট্রান্স জানিয়েছে, ২০২৪ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ছিল রুশ গমের চতুর্থ বৃহত্তম আমদানিকারক।

পলিশচুক বলেন, ইউক্রেনের অধিকৃত অঞ্চল থেকে সংগৃহীত গম রাশিয়া নিজের গমের সঙ্গে মিশিয়ে রপ্তানি করছে বলে তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে।

একজন রুশ গম ব্যবসায়ী বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, যখন রাশিয়ার কোনো বন্দরে রপ্তানির জন্য গমবোঝাই হয়, তখন গমের উৎস শনাক্ত করা খুবই কঠিন। এটা তো হীরার মতো নয় যে শনাক্ত করা যাবে। গমে যেসব মিশ্রণ থাকে, তা দিয়ে উৎস শনাক্ত করা সম্ভব নয়।

এর আগে ১৬ জুন ঢাকার রুশ দূতাবাস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে একটি অনলাইন পোর্টাল ‘দ্য এশিয়া পোস্টে’ প্রকাশিত এ–সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন নাকচ করেছে দিয়েছে। ৪ জুন ওই অনলাইন পোর্টালে রাশিয়ার অধিকৃত ইউক্রেনের অঞ্চল থেকে গম আমদানির অভিযোগসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.