রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ে ধরপাকড়

0
68
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি, ফাইল ছবি: এএফপি

দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বে থাকা একজন প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বরখাস্ত করা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। কিন্তু বরখাস্ত করার পর সেই প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ উচ্চপদস্থ আরও পাঁচ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের কারণ যে শুধু তাঁর জায়গায় নতুন মুখ খোঁজায় সীমাবদ্ধ থাকে না, সেটা বেশ স্পষ্ট। বিশেষ করে এমন ঘটনা যদি ঘটে ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়ায়।

দুই সপ্তাহ আগে আকস্মিক প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই সোইগুকে বরখাস্ত করেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। এরপর দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের কথা বলে একে একে মন্ত্রণালয়ের পাঁচজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ধরপাকড়ের এ ঘটনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে হতাশার জন্ম দিয়েছে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে রদবদল ও ধরপাকড় যেমন কৌতূহলোদ্দীপক, তেমনি এর মেয়াদকালটাও আগ্রহ-জাগানিয়া। ইউক্রেনে প্রায় তিন বছরের যুদ্ধের পর রাশিয়া এই তো সবে সুবিধাজনক অবস্থানে। সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে খারকিভ অভিমুখে যে হামলা শুরু করেছে, তাতেও তারা প্রায় সব ক্ষেত্রে সফল। পূর্ব দিকের দনবাস অঞ্চলেও রুশ বাহিনী জয় পাচ্ছে।

এদিকে সৈন্য ও অস্ত্র-গোলাবারুদের সংকটে ধুঁকছে ইউক্রেন। এই সংকটের মূলে রয়েছে ইউক্রেনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের সামরিক সহায়তা অনুমোদনের জন্য মার্কিন কংগ্রেসে কয়েক মাস ধরে আটকে থাকা। রাশিয়ার ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে ইউক্রেনের এই সংকটও কাজে লেগেছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রগতির পরও কেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধানকে সরিয়ে দিলেন পুতিন?

বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকজন বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলেছে সিএনএন। সেই বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়ার সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার অন্যতম প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। বিপুল অঙ্কের সামরিক ঠিকাদারি চুক্তির বিষয় প্রকাশ করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সম্প্রচারমাধ্যমগুলো। প্রকাশ্যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও তাঁদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের সমালোচনা করছে।

তবে সেই বিশ্লেষকদের একজন সিএনএনকে বলেন, ‘(রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে রদবদল নিয়ে) আমরা যেটা প্রত্যক্ষ করছি, সেটা খুবই জটিল এক খেলা। এ খেলার অনেকগুলো দিক রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এসব ঘটনার মেয়াদকাল এবং পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে জয়ের লক্ষ্যে পুতিনের আত্ম-অনুসন্ধান।’

ব্যর্থ সেনা বিদ্রোহের পর রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ভাড়াটে সেনা সরবরাহকারী রুশ প্রতিষ্ঠান ভাগনারের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন
ব্যর্থ সেনা বিদ্রোহের পর রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ভাড়াটে সেনা সরবরাহকারী রুশ প্রতিষ্ঠান ভাগনারের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন, ফাইল ছবি: রয়টার্স

প্রিগোশিনের ‘শেষ ইচ্ছা’

ধরপাকড় ও রদবদলের কারণে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই ঝাঁকুনির নেপথ্যে রয়েছেন ইয়েভগেনি প্রিগোশিনও। প্রিগোশিন ছিলেন রাশিয়ার ভাড়াটে সেনা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনার গ্রুপের প্রধান। তিনি ‘পুতিনের পাচক’ নামেও পরিচিত ছিলেন।

বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর আগে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই সোইগু ও রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল ভ্যালেরি জেরাসিমভের প্রতি নিজের ক্ষোভের কথা জানিয়েছিলেন প্রিগোশিন। কড়া ভাষায় ভর্ৎসনা ও কটাক্ষ করে তাঁদের সমালোচনা করেছিলেন তিনি। প্রিগোশিনের অভিযোগ ছিল, সোইগু ও জেরাসিমভ একই সঙ্গে যেমন অদক্ষ তেমনি ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্ত।

এটা নিয়েই মস্কোর বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রিগোশিন। ব্যর্থ সেই সামরিক বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল, সোইগু ও জেরাসিমভকে তাঁদের পদ থেকে সরানো। কিন্তু এটা করতে গিয়ে প্রিগোশিন প্রেসিডেন্ট পুতিনকে বিব্রতকর এক পরিস্থিতিতে ফেলেছিলেন। একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন পুতিনের সর্বময় ক্ষমতাকে। এর প্রতিক্রিয়ায় প্রিগোশিনকে দেশদ্রোহী হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন পুতিন। একই সঙ্গে তাঁকে নিজের ‘আস্থাভাজনদের’ তালিকা থেকে ছেঁটে ফেলেছিলেন। কিন্তু সেই ব্যর্থ বিদ্রোহের পর রহস্যজনক এক বিমান দুর্ঘটনায় নিজের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে নিহত হন প্রিগোশিন।

এরপর থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অস্ত্র কেনা, ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ বাহিনীর দুর্বলতা ও দুর্নীতির অভিযোগের মতো বিষয়গুলো লোকচক্ষুর আড়াল করে রেখে এসেছেন পুতিন। এর মধ্য দিয়ে তিনি মূলত ব্যর্থ সেই বিদ্রোহ নিয়ে যে ক্ষুব্ধ, সেই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে চাননি। কারণ, এটা করলে রাশিয়ার জনগণের সামনে তাঁর সর্বময় ক্ষমতা ও শক্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ তৈরি হতো।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য হয়তো অপেক্ষা করছিলেন পুতিন। গত মার্চের সেই নির্বাচনে পুতিন আবারও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এরপর গত ৯ মে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও পুতিন ও সোইগুকে পাশাপাশি হৃদ্যতাপূর্ণ অবস্থায় দেখা গিয়েছিল। কিন্তু বিজয় দিবসের কয়েক দিন পর সোইগুকে বরখাস্ত করেন। মন্ত্রণালয়ে শুরু হয় ধরপাকড়।

তবে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করলেও সোইগুকে নিজের ক্ষমতাবলয়ের মধ্যে রেখেছেন পুতিন। বরখাস্ত করার পর সোইগুকে নিরাপত্তা পরিষদের সচিবের নতুন দায়িত্বে এনেছেন।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ফাইল ছবি: এএফপি

পুতিনের স্বার্থ

কার্নিজ রাশিয়া ইউরোশিয়া সেন্টার নামে একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ ফেলো তাতিয়ানা স্তানোভায়া সিএনএনকে বলেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে প্রিগোশিন যা বলেছিলেন, তা ঠিক ছিল না বেঠিক ছিল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাঁর মতে, রাশিয়ার রাজনীতিতে ঠিক ও ভুল বলে কিছু নেই। সেখানে যা আছে, তা হলো কেবলই স্বার্থ।

পুতিনের স্বার্থ হলো তাঁর ‘ঘরে’ যেন শৃঙ্খলা থাকে। কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো ইউক্রেনে বিজয় অর্জন। আর ইউক্রেনে এ যুদ্ধ কীভাবে শেষ হবে, তার কেন্দ্রে রয়েছে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।

সের্গেই সোইগুকে সরিয়ে আন্দ্রেই বেলুসভকে নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন পুতিন। বেসামরিক ব্যক্তি ও অর্থনীতিবিদ আন্দ্রেই বেলুসভকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিয়োগ করার মধ্য দিয়ে পুতিন এই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে চলতি বাজেটে সামরিক খাতের জন্য রেকর্ড সর্বোচ্চ যে বরাদ্দ দিয়েছেন, তার আওতায় আরও দ্রুত ও সুলভ মূল্যে অস্ত্র কিনতে চান তিনি।

রাশিয়ার চলতি বছরের বাজেটের ৬ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে সামরিক খাতের জন্য, যা আধুনিক রাশিয়ার ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এবারের বাজেটে সামরিক খাতের বরাদ্দ সামাজিক খাতকেও ছাড়িয়ে গেছে। পুতিন যে দেশে যুদ্ধকালীন একটি অর্থনীতি চাইছেন, সামরিক খাতের জন্য এই বরাদ্দ তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

রাশিয়ার সেনাবাহিনীর উপপ্রধান ভাদিম শামারিন, ফাইল ছবি: রয়টার্স

দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন

অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাভিত্তিক ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সের ভিজিটিং ফেলো রুশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিখাইল কোমিন সিএনএনকে বলেন, রাশিয়ার অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে যাঁরা সরকারি নীতি ও অর্থনীতিকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম সোইগু ও তাঁর দলবল।

গত শুক্রবার রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর উপপ্রধান এবং মেইন কমিউনিকেশন ডিরেক্টরেটের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ভাদিম শামারিনের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগ, যোগাযোগ সরঞ্জাম সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তিনি ৩ কোটি ৬০ লাখ রুবল (রাশিয়ার মুদ্রা) ঘুষ নিয়েছেন। এর বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানটিকে বিপুল অঙ্কের সরকারি ঠিকাদারির কাজ দিয়েছেন তিনি।

দীর্ঘদিন দায়িত্বে থাকার পর সম্প্রতি বরখাস্ত রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই সোইগুফাইল ছবি: রয়টার্স

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে যে ধরপাকড় চলছে, তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্প্রচারমাধ্যমগুলো। শামারিনকে গ্রেপ্তার করার পর গত মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্প্রচারমাধ্যম রিয়া নভোস্তির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শামারিনের স্ত্রী ২০১৮ সালে ২ কোটি রুবল (২ লাখ ১৮ হাজার ডলার) দিয়ে বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছিলেন। অথচ সেই সময় শামারিনের বাৎসরিক আয় ৩৪ হাজার ডলারের বেশি ছিল না।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের যে পাঁচজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে একজন উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী তিমুর ইভানভ। গত এপ্রিলে তাঁকে গৃহবন্দী করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধেও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ইভানভ ও তাঁর মেয়ে বন্ধুরও বিলাসী জীবনযাপন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

গুঞ্জন উঠেছে এখন পুতিনের ‘টার্গেট’ সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ ভ্যালেরি জেরাসিমভ। কার্নিজ রাশিয়া ইউরোশিয়া সেন্টারের ফেলো তাতিয়ানা স্তানোভায়া সিএনএনকে বলেন, ‘এখন চারপাশে গুঞ্জন ছড়িয়েছে যে জেরাসিমভকেও উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে।’

বার্লিন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.