রূপকথার গল্পের মতো বলি, সে অনেক অনেক দিন আগের কথা…। রাস্তাঘাট তখন এতটা উন্নত হয়নি। বাস কিংবা ট্রেনে যাতায়াত এখনকার মতো আরামদায়ক ছিল না। নানাবাড়ি ময়মনসিংহের রসুলপুর গ্রামে গিয়েছিলাম বেড়াতে। ঢাকায় ফেরার দিন ভোরবেলা কয়েক ঘণ্টা রিকশায় জার্নি করে গফরগাঁও স্টেশনে এসেছি, কিন্তু ট্রেনের দেখা নাইরে ট্রেনের দেখা নাই।
আমরা পরিবারের ছোট-বড় মিলিয়ে জনা সাতেক, সঙ্গে বাবার সহকর্মী শাহেদ কামাল চাচা (কবি সুফিয়া কামালের বড় সন্তান এবং পরবর্তী সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক) এবং তাঁর আদরের ছোট্ট ভাগনি তিয়া। স্টেশনে বসার জায়গার তেমন ব্যবস্থা ছিল না। খাওয়াদাওয়ার দোকানপাটও তেমন নেই। সবচেয়ে বড় যে ‘নেই’, তা হলো, ট্রেন কখন আসবে—সেই তথ্যটি জানা নেই। স্টেশনমাস্টার শুধু জানেন শিডিউল ট্রেন সময়সূচি মতো আসছে না। তিনি একটা করে সম্ভাব্য সময় দেন, সেই সময় পেরিয়ে গেলে যাত্রীরা আবার তাঁর কাছে হুড়মুড় করে গিয়ে উপস্থিত হন, তিনি আবার একটা সময় দেন…। এভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। প্রতিবারই আশায় বাঁধি বুক—এইবার মনে হয় আসবেই। এদিকে অপেক্ষার ক্লান্তি, খিদে, অপরিচ্ছন্ন প্ল্যাটফর্মে আমরা হাঁপিয়ে উঠেছি।
রাত তখন ৯টা কি ১০টা হবে। স্টেশন লাগোয়া একটা বাড়ি থেকে এক ভদ্রলোক এসে আমাদের তাঁর বাড়িতে যেতে অনুরোধ করলেন। তাঁর কথার সারমর্ম হলো—বাড়ির জানালা দিয়ে সকাল থেকেই তাঁরা আমাদের দেখছেন। আমাদের কষ্টটাও বুঝতে পারছেন। মেয়েদের ব্যবহার করার মতো কোনো শৌচাগার নেই, খাবারের দোকান নেই, শিশুরাও কষ্ট পাচ্ছে। অতএব তাঁদের বাড়ি গিয়ে চারটা ডাল-ভাত মুখে দিতে হবে এবং তাঁর বাড়ি যেহেতু প্ল্যাটফর্মের পাশেই, ট্রেন এলেও ট্রেন মিস হবে না। তিনি নিজে উঠিয়ে দিয়ে যাবেন।
একজন অপরিচিত মানুষের আমন্ত্রণে কী করে যাই? বড়রা পরামর্শ করলেন। যাবে কি যাবে না, আবার উপায়ও নেই। সবচেয়ে বড় কথা, ভদ্রলোকের বলায় এমন সরল আন্তরিকতা ছিল, যা উপেক্ষা করা যায়নি। তাই বার কয়েক ‘না না’ ‘থাক থাক’ করেও আমরা দলেবলে সেই টিনশেডের বাড়িতে গিয়ে নলকূপের ঠান্ডা পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে এবং ঢকঢক করে এক গ্লাস করে পানি খেয়ে জীবন ফিরে পেলাম। ভদ্রলোক শুকনা গামছা নিয়ে আমাদের পেছনে এসে দাঁড়ালেন। বারবার বলতে থাকলেন, বাড়ির সবার খাওয়া শেষ, শিশুরা ঘুমিয়েও পড়েছে, তাঁর স্ত্রী দ্রুত গরম ভাত, ডাল আর সামান্য আলুভাজা করতে পেরেছেন। বেশি কিছু করতে পারলেন না বলে তিনি লজ্জিত! আমার এবং পরিবারের অনেকের স্মৃতিতে এখনো আছে সেই খাবার টেবিলের ওপর বোলে রাখা গরম ভাতের ধোঁয়ার গন্ধ! এর সঙ্গে যুক্ত হলো উঠান থেকে তুলে আনা গাছের লেবুর গন্ধ। আহ্ অমৃত! স্বামী-স্ত্রী দুজন জনে জনে বেড়ে বেড়ে খাওয়ালেন। আমরা হাপুসহুপুস করে পেট ভরে খেয়েছিলাম। ভদ্রলোক তাতেও থামলেন না। আরেকটু নেন, আরেকটু নেন। আমরা টেবিল ছেড়ে উঠে গেলাম, তিনি ডালের বাটি হাতে আমাদের পেছনে ছুটছিলেন ‘আরেকবার, আরেকবার…’
আজ এত বছর পরও পারিবারিক আড্ডায় সেই অভাবিত আপ্যায়নের স্মৃতি বারবার ফিরে আসে। আমরা প্রত্যেকে জীবনে প্রতিদিন খাবার খাই। ঘরে, বাইরে, রেস্তোরাঁয়, দাওয়াতে। কয়টা দিনের কথা আমাদের মনে থাকে? থাকা সম্ভবও নয়। কিন্তু কি আশ্চর্য, এত পোলাও, কোরমা, বিরিয়ানি, ভাত, শুঁটকি ভর্তা, চাইনিজ, জাপানিজের ভিড়ে সেই ডাল-ভাত-লেবুই ছক্কা হাঁকিয়ে স্মৃতির খাতায় রেকর্ড গড়ে ফেলল।
আজও কোনো রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে যখন দেখি, পরিবার-পরিজন নিয়ে কেউ ট্রেনের অপেক্ষায় আছেন, তখন আমার চট করে মনে পড়ে যায় গফরগাঁও স্টেশনের সেই দিনের কথা। বিশেষ করে, এই ঈদের সময় কারওয়ান বাজারের অফিসের ওপর থেকে যখন দেখি, এক এক করে মানুষবোঝাই ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে চলে যাচ্ছে, তখন মনে পড়ে সেই ট্রেনের জন্য অপেক্ষা, অপেক্ষার পর অপরিচিত মানুষের আন্তরিক আমন্ত্রণ, সেই লেবুর গন্ধ, ডালের বাটি, রাতে অবশেষে ট্রেনের কামরায় চেপে বসা, সারা পথ ওই দম্পতির ব্যবহারে মুগ্ধ আমরা তাঁদের নিয়ে প্রশংসা করতে করতে ঝিমিয়ে পড়া…।
তবে ইদানীং একটা সংশয় মনে জাগছে। আজ যদি এমন অপরিচিত কেউ তাঁর বাড়িতে যেতে বলতেন, আমরা কি যেতাম? নাকি কেউ তাঁর নিজের ঘরে, রাতের বেলা এমন অপরিচিত মানুষদের ডেকে ভাত খাওয়াতেন? অবিশ্বাস, সন্দেহ, আমাদের উভয় পক্ষকেই পিছু টেনে ধরত নির্ঘাত। রাত ১০টায় আচমকা জনা দশেক অচেনা অভুক্ত মানুষের জন্য ভাত রেঁধেবেড়ে খাওয়ানোর দিন এখনো কি আছে? সেই দিন গেছে।
আমরা তো এখন গাড়ি নিয়ে সোজা গ্রামের বাড়ির উঠানে চলে যেতে পারি। তবে ফোন না করে, না জানিয়ে আচমকা অপরিচিত তো দূরে থাক, পরিচিত কেউ ইন্টারকম থেকে যদি জানায় তিনি এসেছেন, তখন কপালটা একটু কুঁচকে যায় বটে!