সময় দেওয়া হয় এক মিনিট। এর মধ্যে দরজা না খুললে দরজা ভেঙে তাঁদের বের করে আনা হবে। এক মিনিট পার হতেই হামলা চালিয়ে দরজা ভেঙে দুই নারীকে বের করে আনা হয়। প্রকাশ্য রাস্তার বিদ্যুতের খুঁটির (খাম্বার) সঙ্গে বেঁধে করা হয় নির্যাতন। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী এলে পালিয়ে যায় হামলাকারীরা।
গত বুধবার সকাল ১০টার দিকে রাজশাহী নগরের আসাম কলোনি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় একটি পরিবার ও ছাত্র আন্দোলনকারী পরিচয়ে আসা এক দল ছাত্রের বিরুদ্ধে ওই হামলার অভিযোগ ওঠে। ওই ছাত্ররা গায়ে ট্রাফিক পুলিশের মতো কোটি পরে ছিলেন। বিষয়টি মীমাংসা করার অজুহাতে দুই দিন থানায় মামলা করতে দেওয়া হয়নি।
হামলাকারীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনকারী নন—আন্দোলনকারীরা নিশ্চিত করার পর তাঁদের পরামর্শে নির্যাতনের ঘটনায় মামলা করা হয়। গতকাল শুক্রবার রাতে ভুক্তভোগী নারীর স্বামী রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে নগরের চন্দ্রিমা থানায় মামলাটি করেন। এজাহারে তাঁর স্ত্রী আকলিমা খাতুন ওরফে শাপলা (৩২) ও তাঁর ছোট ভাই মিজানুর রহমানের স্ত্রী শারমিন আক্তারকে (৩১) বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নির্যাতনের অভিযোগ করা হয়।
রফিকুল ইসলামের পরিবার মূলত ফরিদপুরের বাসিন্দা। ৪০ বছর ধরে ব্যবসায়িক সূত্রে তাঁরা রাজশাহী থাকেন। নগরের আসাম কলোনির একটি বাসার একাংশ কিনে ও একাংশ ভাড়া নিয়ে বসবাস করেন। বাসার মূল মালিক স্বপন হাসান (৩২)। এই বাড়িতে হামলা করে ভুক্তভোগী দুই নারীকে দরজা-জানালা ভেঙে বাইরে এনে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। তাঁদের বাঁচাতে গিয়ে বাড়ির মূল মালিক স্বপনের ভাবি সোনিয়া খাতুনকেও (২৮) মারধর করা হয়। মামলার এজাহারে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার লুটের অভিযোগও করা হয়েছে।
মামলায় আসাম কলোনির বাসিন্দা শাহিন, তাঁর স্ত্রী সাহিদা বেগম (৪২), ১৬ বছরের এক কিশোরী এবং স্থানীয় বাসিন্দা মনিরের মেয়ে মুক্তার (৩৫) নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ছাত্র-পরিচয়ে যাঁরা হামলা করতে আসেন, তাঁদের অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।
ছাত্র পরিচয়ে আসা হামলাকারীদের এজাহারে নাম না থাকার বিষয়ে চন্দ্রিমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘ছাত্রদের ওরা তো পরিচয় পায়নি। তাই অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে রাখা হয়েছে।’
ঘটনার পর বাড়ির মালিক স্বপন হাসান বলেছিলেন, তাঁরা মামলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু দুই ছাত্র ফোন করে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মীমাংসা করে দেওয়ার সময় নিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় তাঁরা এসে সব শুনে বলেন, ‘হামলাকারীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনকারীদের কেউ নন। তাঁরা এ ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন।’
যা ঘটেছিল সেদিন
বুধবার রাতে ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা থানায় মামলা করতে যান। সেখানে এই প্রতিবেদকও উপস্থিত ছিলেন। থানায় ভুক্তভোগী শারমিন, তাঁর জা আকলিমা ও স্বপনের ভাবি সোনিয়া খাতুন এই প্রতিবেদকের কাছে নির্যাতনের বর্ণনা দেন। শারমিন বলেন, প্রতিবেশী শাহিনের অটোরিকশা গ্যারেজের শব্দদূষণ নিয়ে তাঁর সঙ্গে ঘটনার দিন সকালে একটা ঝামেলা হয়। তারপর তারা ওই ছাত্রদের নিয়ে এসে তাঁদের বাড়িতে হামলা করে।
শারমিন বলেন, ‘ছাত্ররা এসে আমাদের বাইরে যেতে বলে। বলে, “ক্ষমতায় এখন আমরা।” ভয়ে আমি আমার জাকে (আকলিমা) মানুষ ডাকতে বলি। শুনে ওরা বলে, “মানুষ ডাইকি কী করবে, শেখ হাসিনাকেই আমরা গদি থেকে নামাইছি। তোর জা মানুষ ডাইকে কী করবে, ছাত্রদের কিছু করতে পারবে? তোর কোন বাপ আছে নিয়ে আয়।’ আমি বললাম, ‘তোমরা না ছাত্র। আমি তোমাদের মায়ের মতো। তখন ধমক দিয়ে বলল, “এই চুপ”! সানিয়া ভাবি ওদের অনুরোধ করে বললেন, “তোমরা একটু থামো বাবা, ওরা বাচ্চাদের একটু খাওয়াচ্ছে।” ওরা বলল, “খাওয়াচ্ছে? এক মিনিট সময় দিলাম। এক মিনিটের মধ্যে বের না হলে আমরা ভাঙচুর করব। ওদের মারধর করব।” তখন আমরা ভাবিকে বাইরে রেখে দরজা বন্ধ করে দেয়। ওরা ভাবিকে মাটিতে ফেলে নির্যাতন করে। এক মিনিট পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজা ভেঙে আমাদের দুজনকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে বের করে বিদ্যুতের খাম্বার সঙ্গে বেঁধে লাঠি দিয়ে পেটাতে লাগল।’
শারমিন আরও বলেন, ‘কিশোরী মেয়ে এসে দুই গালে দুইটা থাপ্পড় দিল। তার মা হাতে তালি দিতে লাগল। মারের দৃশ্য ভিডিও করতে করতে বলল, “নেটে ছেড়ে দিব।” ছাত্রদের দলে একজন মেয়ে ছিল, মেয়েটি দূর থেকে এসে আমার পেটের ওপরে জোরে লাথি মারল। আমার তিনটা বাচ্চা অপারেশন করে হয়েছে। সেই পেটে লাথি মারল।’ বলেই শারমিন কাঁদতে লাগলেন। বললেন, ‘খবর পেয়ে সেনাবাহিনী এলে ওরা পালিয়ে যায়।’
মীমাংসার অজুহাতে মামলায় ঢিলেমি
বাড়ির মালিক স্বপন হাসান বলেন, বুধবার রাতে থানায় মামলা করার সময় ওলিউল্লাহ নামের একজন ছাত্র পরিচয় দিয়ে আবার মীমাংসা করে দেওয়ার কথা বলে মামলা না করার অনুরোধ করেন। তাঁর কথামতো ওই রাতে মামলা না করে বাদী রফিকুল ইসলাম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে চলে আসেন।
পরদিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর হামলাকারী দুজনকে নিয়ে আসাম কলোনির ওই বাসায় আসেন ওলিউল্লাহ। ওই দুজন হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্র শুয়াইব আহমেদ। বাড়ি নগরের বিনোদপুর এলাকায়। অন্যজন হলেন শাহ মখদুম নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থী কোয়েল আক্তার মনিক। তাঁর বাড়ি নগরের চণ্ডীপুর ভাটাপাড়া এলাকায়। এ সময় হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া শুয়াইব আহমেদের সঙ্গে বাসার ভেতরে কথা হয়। তিনি বলেন, তাঁদের ভুল বুঝিয়ে ডেকে আনা হয়েছিল। তাঁদের ভুল হয়েছে।
মীমাংসার সময় মহল্লার উত্তেজিত লোকজন বাসা ঘেরাও করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরে রাত নয়টার দিকে ছাত্রদের কৌশলে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। এ সময় ওয়ালিউল্লাহ একটি সাদা কাগজে লিখে যান, ‘কেউ যদি বাড়ির ক্ষতিপূরণ না দেয়, আমি ওয়ালিউল্লাহ নিজেই দিব।’ তবে আজ শনিবার সকালে ওয়ালিউল্লাহর মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
ওই ছাত্ররা চলে যাওয়ার পর রাতে ছাত্র পরিচয়ে আরও দুজন ওই বাড়িতে যান। তাঁরা সব শুনে মামলা করার পরামর্শ দিলে রাতেই মামলা করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বয়কদের একজন মেহেদী সজিব বলেন, এ ব্যাপারে তাঁরা কিছুই জানেন না। তাঁদের সমন্বয়কেরা এ কাজে যুক্ত নন। সমন্বয়ক নামে নানা জায়গায় নানা ঘটনা ঘটছে। এ ব্যাপারে সবার সোচ্চার হওয়া দরকার। তাঁরা বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।