দেশের ব্যাংকিং খাতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে বড় সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে ঋণ খেলাপিদের ধরতে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংক খাতে পাহাড়সম হয়ে দাঁড়িয়েছে খেলাপি ঋণ। সুশাসনের অভাবও দীর্ঘদিনের। প্রতিনিয়তই দুর্বল হয়ে পড়ছে কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক। তারল্য সংকটসহ ব্যাংকগুলোতে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। এই পরিস্থিতিতে টাকা ছেপে ওই কয়েকটি ব্যাংককে নিয়মিত তারল্য সহায়তা করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এমন পরিস্থিতিতে বুধবার (৩১ জানুয়ারি) নতুন বছরের প্রথম ব্যাংর্কাস সভার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানেই ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের এসব নির্দেশ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। সভায় উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি গভর্নরসহ বিভিন্ন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা।
সভায় মামলার জালে আটকে পড়া অর্থ আদায়ে অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এমডিদের। একইসঙ্গে দ্রুত সময়ের মধ্যে ক্রলিং পেগ বাস্তবায়ন, কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে ধার দেওয়া, প্রমোট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ) বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোকে প্রস্তুতি নিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া সংকটে থাকা দূর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে।
সভা শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, গত ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর সংস্কারের জন্য আমরা প্রমোট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ঘোষণা করেছি। সংস্কারের ক্ষেত্রে কীভাবে ব্যাংকগুলোর অবস্থান নির্ণয় করা হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট বর্ণনা দেওয়া আছে।
তিনি বলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিকের হিসাব ধরে আগামী বছরের মার্চ নাগাদ ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা শুরু হবে। ব্যাংকগুলোর এমডিদের ব্যক্তিগতভাবে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার প্রতি দৃষ্টি দিতে বলা হয়েছে। যেসব ব্যাংকের অবস্থা খুবই দুর্বল তাদের ঋণ বিতরণ, আমানত সংগ্রহ থেকে শুরু করে কার্যক্রমের উপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। কোনো কোনো ব্যাংক একীভূত (মার্জার) করেও দেওয়া হতে পারে। এ সময়ের মধ্যে ব্যাংকগুলো যদি তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করতে পারে তাহলে কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা আসবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, সম্প্রতি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে বলেছি আমাদের টার্গেট বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের মুদ্রানীতি অব্যাহত থাকবে। এতে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সংকট দেখা দিতে পারে। আগে থেকেই তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। যাতে লিকুইডিটি ম্যানেজমেন্ট ঠিকমতো করতে পারে। আমরা চাই দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যাংকের সুশাসন ফেরাতে।
মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংকের সুশাসন ফেরাতে আমরা একটি কমিটি গঠন করেছি। কমিটি একটি অ্যাকশন প্ল্যান করছে। সেখানে খেলাপি ঋণ কমানো এবং সুশাসন নিশ্চিতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে আসবো। মুদ্রানীতি ঘোষণা করার সময় ক্রলিং পেগ চালুর বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছিলাম। দ্রুত সময়ের মধ্যে সেটি বাস্তবায়ন করা হবে। ডলারের মূল্যে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ব্যাংকগুলোকে ক্রলিং পেগ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। তাছাড়া মামলা কমাতে এডিআরের ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এতে হয়তো মামলার সংখ্যা কমে আসবে। কোনো গ্রাহক যেন এই এডিআরের সুবিধা নিয়ে শুধু শুধু সময়ক্ষেপণ না করে, সে ব্যাপারেও ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, গভর্নর বলেছেন, গ্রাহকের রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক না কেন, তিনি ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে কোনো আপস করবেন না। অর্থাৎ আগামীতে ব্যাংকিং সেক্টর ঘুরে দাঁড়াবে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যে ফ্রেমওয়ার্ক দিয়েছে, সে অনুযায়ী ব্যাংকিং পরিচালনা হবে। ব্যাংকের ঋণ খেলাপিদের ধরতে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা করা হবে না। ব্যাংকে সুশাসন ফেরাতে যা যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সব কিছুই নিতে গভর্নর নির্দেশ দিয়েছেন।