করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে দেশের অর্থনীতি যখন সংকটে, তখন রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেখা দিয়েছে নতুন শঙ্কা। জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিরোধী দলগুলোর হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি এ সংকটকে করছে ঘনীভূত। রাজনীতির এমন অনিশ্চিত যাত্রা চলতে থাকলে অর্থনীতিতে আরও বড় ধাক্কা লাগতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের অর্থনীতির এখনকার প্রধান দুই বিপদ– উচ্চ মূল্যস্ফীতি আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে পতন। ডলার সংকটে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে। অসহনীয় পর্যায়ে এসে ঠেকেছে মূল্যস্ফীতি। বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনে রয়েছে ভারসাম্যের ঘাটতি। সর্বশেষ অক্টোবরে রপ্তানি কমেছে ১৪ শতাংশ। রেমিট্যান্স অক্টোবরে বাড়লেও এর আগের তিন মাসে কমেছে। শিল্পের কাঁচামাল এবং মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে, যা বিনিয়োগে ধীরগতির লক্ষণ। সর্বশেষ শ্রম জরিপে কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার তথ্য রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় সরবরাহ, উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানিসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত হলে সংকট আরও বাড়বে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ. মনসুর বলেন, সংঘাতময় রাজনীতি অর্থনীতিকে বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। নির্বাচনের ব্যাপারে শান্তিপূর্ণ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এ পরিস্থিতি হয়তো চলতে থাকবে, যার অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিণাম হবে ভয়াবহ। তবে এখন পর্যন্ত রাজনীতিবিদদের মনোভাবে নমনীয়তার লক্ষণ নেই। কয়েক দিন ধরে যেভাবে উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, তা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ, ডলার সংকট ও কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও সংকুচিত হবে। অর্থনীতির সব খাতেই তৈরি হবে একটা বিরূপ পরিস্থিতি। গত মাসে রপ্তানি কমেছে, আগামীতে আরও কমবে।
উৎপাদনে ব্যবহৃত মূলধনি আমদানি কমে আসার প্রবণতা বেশ উদ্বেগজনক। মূলধনি আমদানি কমে যাওয়া মানে উৎপাদন কমে যাবে। এর ফলে রপ্তানি আরও কমবে। রপ্তানির মাধ্যমে এখন যে পরিমাণ ডলার আসে, তা না আসা মানে রিজার্ভে আরও টানাপোড়েনের পরিস্থিতি তৈরি হওয়া। বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস রপ্তানি খাত। মাসে গড়ে ৫০০ কোটি ডলার আসে পণ্য রপ্তানি থেকে। অক্টোবরে পণ্য রপ্তানি কমছে আগের অর্থবছরের একই মাসের চেয়ে ১৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বরের চেয়ে অক্টোবরে পোশাক রপ্তানি কমেছে ১৩ শতাংশের মতো। মাসটিতে ৩৭৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। গত বছরের একই মাসের চেয়ে যা ৬০ কোটি ডলার কম। গড়ে প্রতি মাসে ৫০০ কোটি ডলারের মতো পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। এ হিসাবে অক্টোবরে ১২৪ কোটি ডলার কম রপ্তানি হয়েছে। এর কারণ হিসেবে নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাতের শঙ্কা, গত কয়েকদিনের রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং ন্যূনতম মজুরির দাবিতে শ্রমিক আন্দোলনকে দায়ী করছেন উদ্যোক্তা রপ্তানিকারকরা।
নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাতের পাশাপাশি কয়েকদিনের শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বাংলাদেশি পণ্যের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্বেগ জানাচ্ছে। সময়মতো হাতে পণ্য পাওয়ার অনিশ্চয়তা থেকে রপ্তানি আদেশ কমিয়ে দিয়েছে কোনো কোনো ব্র্যান্ড ক্রেতা। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘ক্রেতারা উদ্বিগ্ন। তারা আমাদের কাছ থেকে পরিস্থিতি বুঝতে চাচ্ছেন। ঢাকায় বায়ার্স ফোরামের পক্ষ থেকে বৈঠকের জন্য সময় চাওয়া হয়েছে।’
পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক দিনের রাজনৈতিক সংঘাত এবং শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় ক্রেতারা উদ্বেগ জানিয়ে তাদের কাছে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা জানতে চেয়েছেন। এমনিতেই নতুন রপ্তানি আদেশ কম। এর মধ্যে বর্তমান রপ্তানি আদেশের ওপর মূল্যছাড় চেয়েছে কোনো কোনো ক্রেতা। আকাশপথে পণ্য পৌঁছাতেও চাপ দিচ্ছে কিছু ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। সাধারণত সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন করা হয়। আকাশপথে পরিবহন খরচ সমুদ্রপথের চেয়ে অনেক বেশি।
বাংলাদেশে নির্বাচন ঘিরে সংঘাতের অভিজ্ঞতায় আগে থেকেই উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন ব্র্যান্ড ক্রেতারা। মাস দেড়েক আগে কয়েকটি বড় ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিরা বিজিএমইএ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে জানান, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সম্ভাব্য রাজনৈতিক সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে সময়মতো পণ্য হাতে পাবেন কিনা, সে বিষয়ে তারা উদ্বিগ্ন।
বিনিয়োগ ও উৎপাদনকেন্দ্রিক আমদানি কমছে
এ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমছে প্রায় ২০ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে তৈরি পোশাকের বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল আমদানি কম হয়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ। পোশাক উৎপাদনে প্রধান কাঁচামাল তুলা আমদানি কম হয়েছে সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৩৯ শতাংশ। সুতা, কাপড়সহ অন্যান্য কাঁচামালও প্রায় একই হারে কমেছে। পোশাকের বাইরে অন্যান্য কাঁচামালের আমদানি কম হয়েছে ৩৬ শতাংশেরও বেশি। কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়া মানে হচ্ছে, উৎপাদন কমে যাওয়া। উৎপাদন কমে যাওয়া মানে রপ্তানি কমে যাওয়া। দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি বোঝা যায় মূলধনি যন্ত্রের আমদানি চিত্রে।
ক্ষতি হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও পণ্য সরবরাহে বিভিন্ন সমীক্ষার বরাতে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির মহাসচিব মো. জহিরুল হক ভূঁইয়া বলেন, এক দিন হরতাল দিলে ৬ থেকে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। অবরোধের ক্ষতির অঙ্কটাও বিশাল। অবরোধে কিছু দোকানপাট খোলা থাকে। তবে ক্রেতা থাকেন কম। কিছু বেচাকেনা হলেও অন্তত ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয় এক দিনের অবরোধে।
তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে সরকার ও বিরোধী দল সবার সংযত আচরণ করা উচিত। দেশ সবার ওপরে– এমন মনোভাব মাথায় রেখে কমবেশি সবাইকে ছাড় দিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করা হোক। কারণ আরও হরতাল-অবরোধ হলে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্যবসায়ীরা পুঁজি সংকটে পড়বেন। এতে অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, করোনায় সারাবিশ্বের অর্থনীতি মারাত্মক চাপে পড়েছিল। এর পর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম। গেল এক বছরে দফায় দফায় বেড়েছে ডলারের দাম। অনেক ব্যাংক ঋণপত্র (এলসি) খুলতে চাচ্ছে না। এতে আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনীতিতেও এর চাপ পড়েছে। ব্যবসায়ীরা যখন এসব সংকট কাটিয়ে উঠার জন্য লড়াই করছেন, ঠিক সেই সময় শুরু হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা। একের পর এক আসছে হরতাল-অবরোধ। এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বেশি বাধার মুখে পড়ে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা। এর সঙ্গে জড়িত পুরো বাজার ব্যবস্থাপনা। পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক না থাকলে এর প্রভাব পড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে। ক্ষতিগ্রস্ত হন দেশের সব খাতের ছোট-বড় সব ব্যবসায়ী। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে না দিয়ে দলগুলোকে আলোচনা করে সমাধান করা উচিত।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সহসভাপতি ড. যশোধা জীবন দেবনাথ বলেন, হরতাল-অবরোধ নিয়ে ব্যবসায়ীরা চিন্তিত। এতে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বাজারে বেশির ভাগ জিনিসের দাম বাড়তি। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা মনে করেন যে কোনোভাবেই হোক রাজনৈতিক সমঝোতা হওয়া দরকার। সবাইকে অর্থনীতি ও দেশের স্বার্থ বিবেচনা করতে হবে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার হলো পাইকারি পণ্য বেচাকেনার অন্যতম বড় বাজার। কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন বলেন, অবরোধের কারণে আগের চেয়ে অন্তত ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পণ্যবাহী ট্রাক কম আসছে। অনেকেই অবরোধের আগেই পণ্য মজুত করে রেখেছেন। সেগুলোই এখন বিক্রি হচ্ছে। তবে বাজারে ক্রেতা অনেক কম। এভাবে অবরোধ চলতে থাকলে এবং পণ্যবাহী ট্রাক আসতে না পারলে সরবরাহ চেইনে সমস্যা দেখা দেবে।
অবরোধে গাড়ি ভাড়া বেড়েছে উল্লেখ করে এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, বিরোধী দলের জ্বালাও-পোড়াও কর্মকাণ্ডের কারণে অনেক গাড়ি ভয়ে রাস্তায় নামতে চায় না। যেসব ট্রাক ঝুঁকি নিয়ে পণ্য পরিবহন করছে, তারা আগের চেয়ে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়েছে। এটি ব্যবসায়ীদের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে। কারণ এতে পণ্যের খরচ বেড়েছে। যার প্রভাব পড়বে দামে।