২০২০ সাল, মার্চ মাস। কভিড মহামারি আঘাত হেনেছে বাংলাদেশেও। অদৃশ্য ভাইরাসের আতঙ্কে দুশ্চিন্তায় ভর করে চলতে থাকে জীবন। মানুষ অনলাইনে তথ্যের আদান-প্রদানে অভ্যস্ত হতে থাকে। ওই সময় থেকেই ঘরবন্দি সময়কে পারিবারিক নির্যাতনের ঊর্ধ্বগতির জন্য দায়ী করেন মানবাধিকারকর্মীরা। তবে ২০২১ সালে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ে উদ্বেগজনকভাবে। বিশিষ্টজনরা মনে করেন, ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণ ও হত্যা এবং পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বিগত সময়ের তুলনায় এখন উদ্বেগজনকভাবে বেশি ঘটেছে। নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা রোধে দেশে যথেষ্ট কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। বিচারহীনতা, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা ও অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা ক্রমাগত ঘটেই চলেছে।
চলতি বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) এক ছাত্রী স্থানীয় বখাটে যুবকদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন। ৩ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার চুন্টা ইউনিয়নের নরসিংহপুর গ্রামে ১৭ বছর বয়সী এক বাকপ্রতিবন্ধী ধর্ষণের শিকার হয়। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে প্রতিনিয়ত দেশের নারী ও শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ফলে ধর্ষণের চিত্রটা আরও উদ্বেগজনক আকার ধারণ করতে পারে বলে মনে করেন বিশিষ্টজন।
‘মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রতিবেদন’-এ বলা হয়, ২০২১ সালে ৬৯২ নারী এবং ৯৪৫ শিশু ও কিশোরী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৩৯৬টি; দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ১০৭ জন নারী; ধর্ষণ ও হত্যার শিকার ১১ জন নারী; ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন নারী; ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৮২ জনকে ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৮২ জন নারী। এ ছাড়াও প্রতিবন্ধী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১১ জন। অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার ১৬ জন নারী। অপরদিকে, ২০২১ সালে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় শারীরিক নির্যাতনে ৩৩০ জন; ৮২ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ ৫৭৮ জন নারী হত্যার শিকার হয়েছেন। আত্মহত্যা করেছেন ৪২৩ জন নারী। অপহরণ করা হয়েছে ৫ জন নারীকে; নিখোঁজ রয়েছেন ২৩ জন নারী। এই সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১৪ জন প্রতিবন্ধী নারী। ৯৪৫টি শিশু ও কিশোরী যৌন নির্যাতনের ঘটনায় ৪৭৯ জন শিশু ও কিশোরী ধর্ষণ; ১১২ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছে ২৫ জন শিশুকে। ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন শিশু-কিশোরী; ৭৮ জন প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন; যৌন হয়রানির শিকার ১১১ জন শিশু-কিশোরী ও ১৩৭ জন শিশু-কিশোরীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ২০২১ সালে শিশুদের প্রতি সহিংসতার ঘটনায় শারীরিক নির্যাতনে ১০৬ জন, ২৪ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ ১৯৫ জন শিশু-কিশোরী হত্যার শিকার হয়েছেন। আত্মহত্যা করেছে ২৩৬ জন শিশু। অপহরণ করা হয়েছে ৩৮ শিশুকে; নিখোঁজ রয়েছে ৫৫ শিশু। এ বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় ৩৫ জন জীবিত ও ৫৮ জন মৃত মোট ৯৩ জন নবজাতক শিশুকে পাওয়া গেছে, যা অমানবিক।
বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র ৯টি পত্রিকায় ছাপা হওয়া খবর ও নিজস্ব প্রক্রিয়ায় তথ্য সংকলন করে। সংগঠনের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে ধর্ষণের শিকার ১৩২১ নারী এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৭ জনকে। সংস্থাটির সহকারী সমন্বয়কারী অনির্বাণ সাহা বলেন, ২০২০ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন মোট এক হাজার ৬২৭ নারী এবং ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল এক হাজার ৪১৩। শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার পোড়াগাঁও গ্রামে গত ৯ অক্টোবর এক গৃহবধূ ও তার চতুর্থ শ্রেণিপড়ূয়া মেয়েকে দলবদ্ধ ধর্ষণের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘ভুক্তভোগী গৃহবধূ আটজনকে আসামি করে মামলা করেন। এর পর থেকে আসামিরা মামলা তুলে নিতে তাদের হুমকি-ধমকিসহ নানাভাবে চাপ দিচ্ছে।’
এদিকে, গণপরিবহনেও ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটছে। নারায়ণগঞ্জের বন্দরে যাত্রীবাহী একটি বাসে উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে এক গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। ওই গৃহবধূ জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে যোগাযোগ করলে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। গ্রেপ্তার হয় বাসচালক ও দুই সহকারী। এ ব্যাপারে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বাসমালিকরা চালক ও সহকারীদের দায়বদ্ধতার আওতায় আনতে পারেনি বলে তাদের দুঃসাহস আরও বাড়ছে। একজন নারীর ভীতিমুক্ত পরিবেশে গণপরিবহনে চলাচলের অধিকার রয়েছে।
সংবিধান রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমানাধিকারের কথা বলা হলেও স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও এ দেশের নারীসমাজকে এখনও ব্যাপক বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে।
সাতক্ষীরায় ২২ মাসে তিন শতাধিক নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। করোনাকালীন সাতক্ষীরায় বাল্যবিয়ে মহামারি আকার ধারণ করেছে। তবে এসব ঘটনার দ্রুত বিচার ও বাল্যবিয়ে ঠেকাতে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেই স্থানীয় প্রশাসনের। জানা যায়, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করোনাকালীন ২২ মাসে সাতক্ষীরায় ৩০৯ জন নারী ও শিশু ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১৩ জন ও ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৯৬ জন। করোনাকালীন ধর্ষণের যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি।
আসক-এর অম্বিকা রায় বলেন, করোনাকালে সাতক্ষীরায় বাল্যবিয়ে মহামারি আকার ধারণ করেছে। বাল্যবিয়ের ফলে শিশুরা অনিচ্ছায় যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। যেসব মেয়েকে অপ্রাপ্তবয়সে বিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের বেশিরভাগ বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাদের বিয়েতে বাধ্য করা হয়েছে। জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন উপস্থিতির হার অনেকাংশে কমে গেছে। করোনাকালীন বাল্যবিয়ের হার বালিকা বিদ্যালয়গুলোতে ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ, মাদ্রাসাগুলোতে ১৩ দশমিক ২৯ এবং যৌথ বিদ্যালয়গুলোতে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। বাল্যবিয়ের হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় শিশুদের যৌন নির্যাতনসহ পারিবারিক নির্যাতনের হারও অনেকাংশে বেড়েছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ‘বাড়ি, কর্মস্থল, পরিবহন, রাস্তাঘাট- কোথাও নারী নিরাপদ নন। সর্বত্র নারীর প্রতি এক ধরনের হয়রানি, সহিংসতা, নির্যাতন চলছেই। প্রায় তিন দশক ধরে নারীর জন্য কাজ করার পরও আজ আমরা হতাশ।’ নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় তিনি বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেই দায়ী করেছেন।