যৌন নিপীড়নের শিকার অর্ধেক নারী পুলিশকে বিশ্বাস করেন না

0
105
প্রতীকী ছবি

ব্রিটিশ ইন্টারনেট–ভিত্তিক মার্কেট রিসার্চ ও ডেটা অ্যানালিটিকস ফার্ম ইউগভের গবেষকেরা গত জানুয়ারির শেষের দিকে যুক্তরাজ্যের ১২ হাজার ৫০০ জনের বেশি প্রাপ্তবয়স্কদের নিয়ে একটি জরিপ চালিয়েছেন। এই প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় অর্ধেক নারী। তাঁদের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৭৫৬ জন বলেছেন, তাঁরা গত দুই বছরে এমন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৯৫১ জন পুরুষ ও ৮০৫ জন নারী।

সামগ্রিকভাবে গত দুই বছরে এসব নির্যাতনের শিকার হওয়া প্রতি ১০ নারীর মধ্যে ৪ জনই বলেছেন, তাঁদের মামলার তদন্তে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে তাঁরা হতাশ হয়ে পড়েছেন।

সাউথ লন্ডনে বসবাস করা ৩৩ বছর বয়সী মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ সারাহ এভারার্ডকে ২০২১ সালে তৎকালীন মেট্রোপলিটন পুলিশ অফিসার ওয়েন কুজেনস অপহরণের পর ধর্ষণ ও হত্যা করেন। এর পর থেকে নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে যেকোনো সহিংসতা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পুলিশের অন্যান্য কেলেঙ্কারির মধ্যে নিজ বিভাগের সদস্যদের দ্বারা নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা মোকাবিলায় ব্যর্থতার জন্য দেশটির পুলিশ বিভাগ কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে।

যুক্তরাজ্যে ডেভিড ক্যারিক নামের এক ক্রমিক ধর্ষকও মেট্রোপলিটন পুলিশ অফিসার ছিলেন। ডেভিড আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে নিকৃষ্ট যৌন অপরাধীদের একজন। গত ১৮ বছরে ২৪টি ধর্ষণের অভিযোগসহ তাঁর বিরুদ্ধে ৪৯টি ফৌজদারি অভিযোগ ছিল। তিনি সব অভিযোগ স্বীকার করেছেন। গত মাসে তাঁকে ন্যূনতম ৩০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

জো (ছদ্মনাম) নামের লন্ডনের এক নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন। তিনি বলেন, মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি তাঁর সঙ্গীর দ্বারা সহিংসতার শিকার হন। পুলিশকে তিনি এ অভিযোগ জানিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাঁকে হতাশ করেছে। এর কয়েক বছর পর তিনি আবারও পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু সে সময় অভিযোগ জানানোর বিষয়ে পুলিশকে বিশ্বাস করা তাঁর পক্ষে অনেক কঠিন ছিল।

পুলিশের বিষয়ে নারীদের আস্থা ফেরাতে হলে অবশ্যই একটি বাস্তব পরিবর্তন হতে হবে। এর অর্থ নারীবিদ্বেষ নির্মূল করা, নারীদের বিশ্বাস করা এবং অভিযোগের স্বাধীন তদারকি ও যাচাই করতে হবে।
ভ্যালেরি ওয়াইজ, ভিকটিম সাপোর্টের জাতীয় পারিবারিক নির্যাতন বিভাগের প্রধান

জো বলেন, ‘প্রথমবার তারা (পুলিশ) আমাকে মোটেও গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। আমি একজন অল্পবয়সী মা ছিলাম। তাঁরা আমাকে বলেছিলেন, “আপনার বয়স ১৮ বছর। আপনার আরও ভালোভাবে জানা উচিত। তিনি আপনার সন্তানের বাবা নন, তাহলে কেন তাঁর সঙ্গে আপনি নিজেকে জড়ালেন? আপনার পছন্দ আরও ভালো হওয়া উচিত ছিল।’”

সঙ্গীকে বিচারের মুখোমুখি না করতে পুলিশ চেষ্টা করেছিলেন মন্তব্য করে জো আরও বলেন, পারিবারিক নির্যাতন একতরফা ছিল কি না, তা তাঁর কাছে পুলিশ কর্মকর্তারা জানতে চেয়েছিলেন। তিনি নির্যাতনের কোনো প্রতিশোধ নিয়েছেন কি না, তা–ও জানতে চেয়েছিল পুলিশ।

প্রথমবার পুলিশের কোনো সহযোগিতা পাননি জো। পরে তিনি অন্য সঙ্গীদের দ্বারাও নির্যাতনের শিকার হন। পুলিশকে বিশ্বাস করতে না পারায় এসব অভিযোগ শুরুতে আর পুলিশকে জানাননি তিনি। কিন্তু নির্যাতনের শিকার হয়ে তাঁর জিন যখন হুমকির মুখে, তখন তিনি বাধ্য হয়ে আবারও পুলিশের কাছে অভিযোগ জানান।

প্রথমবার তারা (পুলিশ) আমাকে মোটেও গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। আমি একজন অল্পবয়সী মা ছিলাম। তাঁরা আমাকে বলেছিলেন, “আপনার বয়স ১৮ বছর। আপনার আরও ভালোভাবে জানা উচিত। তিনি আপনার সন্তানের বাবা নন, তাহলে কেন তাঁর সঙ্গে আপনি নিজেকে জড়ালেন?
জো, লন্ডনে পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী

জো বলেন, ‘পুলিশ পরে আমার সঙ্গীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল ঠিকই, কিন্তু এসব ব্যাপারে আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। এতে আমাকে বিপদে পড়তে হয়েছিল। আমি এখনো নিজের সম্পত্তি নিয়ে আছি। তার (সঙ্গী) সঙ্গে এখনো আমার যোগাযোগ আছে, আমার মোবাইল ফোন এখনো তার নিয়ন্ত্রণে আছে। পুলিশ আমার সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করেই কাজ করছে। তারা মানুষকে সময় হতাশ করে দেয়।’

ভিকটিম সাপোর্টের জাতীয় পারিবারিক নির্যাতন বিভাগের প্রধান ভ্যালেরি ওয়াইজ বলেছেন, ‘আমরা যে নারীদের সহায়তা করি, পুলিশের প্রতি তাঁদের আস্থার সংকট একটি বাস্তব সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা নতুন কোনো সমস্যা নয়। এর পেছনে নিঃসন্দেহে পুলিশ কর্মকর্তাদের দ্বারা সংঘটিত নির্যাতনের অনেক ভয়ংকর গল্পও আছে।’

ভ্যালেরি ওয়াইজ আরও বলেন, ‘নারীদের বারবার বলা হয়, এসব বিষয় পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নারীরা আরও বেশি নির্যাতনের মুখোমুখি হচ্ছেন। আর যাঁরা সাহস করে অভিযোগ করেন, প্রায় সময় তাঁদের হতাশ করে দেওয়া হয়। তাঁদের গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয় না এবং তাঁদের কথাও শোনা হয় না।’ পুলিশের বিষয়ে নারীদের আস্থা ফেরাতে হলে অবশ্যই একটি বাস্তব পরিবর্তন হতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন ভ্যালেরি।

ভ্যালেরি ওয়াইজ বলেন, ‘এর মানে হলো পুলিশব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হতে হবে। এর অর্থ নারীবিদ্বেষ নির্মূল করা, নারীদের বিশ্বাস করা এবং অভিযোগের স্বাধীন তদারকি ও যাচাই করতে হবে।’

মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার স্যার মার্ক রাউলি বলেছিলেন, মেট্রোপলিটন পুলিশ বর্তমানে এক হাজার যৌন ও পারিবারিক নির্যাতনের অভিযোগ তদন্ত করছে। এসব অভিযোগে প্রায় ৮০০ পুলিশ কর্মকর্তা জড়িত।

গত জানুয়ারিতে রিয়ানন আরজেন্ট নামের যুক্তরাজ্যের সাবেক এক নারী পুলিশ কর্মকর্তা অভিযোগ করেছিলেন, তিনি সহকর্মীর (ভারপ্রাপ্ত সার্জেন্ট) দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তদন্তের সময় পুলিশ তাঁর লিখিত অভিযোগ সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল বলে দাবি করেছেন তিনি।

সে সময় মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার স্যার মার্ক রাউলি বলেছিলেন, মেট্রোপলিটন পুলিশ বর্তমানে এক হাজার যৌন ও পারিবারিক নির্যাতনের অভিযোগ তদন্ত করছে। এসব অভিযোগে প্রায় ৮০০ পুলিশ কর্মকর্তা জড়িত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.