‘যে বিশেষ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রদূতদের বাড়তি নিরাপত্তা, সেটি এখন নেই’

0
204
ফাইল ছবি

ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, সৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনাররা যে বিশেষ পরিস্থিতিতে এতদিন বাড়তি নিরাপত্তা পেয়ে আসছিলেন সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই বলে মনে করছে সরকার। তাই তারা বাড়তি ওই নিরাপত্তা সুবিধা পাচ্ছেন না। তবে রাষ্ট্রদূতদের নিয়মিত নিরাপত্তা সুবিধা অটুট রয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের বাড়তি নিরাপত্তা–সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন বাংলাদেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট ভালো। জঙ্গি দমনে সারা বিশ্বে রোল মডেল বাংলাদেশ। তাই কূটনীতিকদের বাড়তি নিরাপত্তা–সুবিধা দিলে বিদেশিদের কাছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা নিয়ে ভুল বার্তা যায়। তাই বাংলাদেশ কোন ভুল বার্তা দিতে চায় না। এ ছাড়া কয়েকটি দেশকে বিশেষ নিরাপত্তা–সুবিধা দেওয়ায় অন্যান্য দেশও তা চাইছিল। সে কারণে এভাবে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়া অব্যাহত রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না।’

বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের কূটনীতিকদেরও বাড়তি কোনো নিরাপত্তা–সুবিধা দেওয়া হয় না। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের বর্তমান ও সাবেক কূটনীতিকরা জানান, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা বিদেশে এ ধরনের কোন সুবিধা পান না। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মিশন ও মিশন প্রধানদের বাসভবনেও পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হয় না। তাদের জন্য পৃথক গানম্যানও নেই। তারা সেসব দেশে সাধারণ মানুষের মতই চলাফেরা করেন। শুধু নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার গানম্যান সুবিধা পেলেও, সার্বক্ষণিক এসকর্ট বা নিরাপত্তা সুবিধা তাকে দেওয়া হয় না। এছাড়া, বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে বিশেষ কোনো উৎসব আয়োজনে পুলিশি নিরাপত্তা চাওয়া হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশ এ ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করে।

যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা প্রাপ্তবয়স্ক হলেই আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতে পারে। স্কুল, কলেজ, শপিংমলসহ বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে শুটিংয়ের ঘটনা খুবই সাধারণ। প্রায়শই এ ধরনের ঘটনায় অনেক লোক নিহত হচ্ছে। কয়েকজন বাংলাদেশি নিহতের ঘটনাও রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পুলিশি কোন নিরাপত্তা পান না, যা দেশিটির বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত জরুরি। অনেকে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল এবং পাবলিক প্লেসে গুলি চালানোর ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেনি বললেই চলে। বেশকিছুদিন আগে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে একটি মসজিদে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান।

মূলত ঢাকার হোলি আর্টজানে জঙ্গি হামলার ঘটনার পর কিছু রাষ্ট্রদূতের উদ্বেগ ও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে অলিখিতভাবে তাদেরকে গাড়িসহ বাড়তি কিছু লোকবল দেওয়া হয়েছিল। এটি ছিল মূরত চলাচলে সুবিধার জন্য। এ ছাড়া, ২০০৪ সালের মে মাসে যুক্তরাজ্যের তৎকালীন হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর সিলেটে গ্রেনেড হামলার ঘটনার পর থেকে তাকে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্যের অন্য হাইকমিশনাররাও এই নিরাপত্তা সুবিধা পেয়ে আসছিলেন।

বর্তমানে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রণাধীন আছে। তাই তাঁদের বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়ার আবশ্যকতা নেই বলে মনে করছে সরকার। পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর কার্যপরিধি বৃদ্ধির জন্য এই বাড়তি সুবিধা অব্যাহত রাখা যাচ্ছে না। তবে শুধু এসকর্ট সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। অন্যান্য সকল নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের মতোই থাকবে। রাজধানীর বারিধারা, গুলশানসহ কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তার জন্য পুলিশের একটি আলাদা শাখা ‘ডিপ্লোমেটিক সিকিউরিটি ডিভিশন’ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে প্রায় ১১০০ পুলিশ কর্মকর্তা/কর্মচারী আছেন। তারা সার্বক্ষণিক দূতাবাস এলাকার নিরাপত্তায় নিয়োজিত। মার্কিন দূতাবাস, আমেরিকান সেন্টার, আমেরিকান ক্লাব ও রাষ্ট্রদূতের বাসভবনকে কেন্দ্র করে প্রায় ২০০ পুলিশ সদস্য প্রতিদিন দায়িত্ব পালন করছেন। তবে যে সাত পুলিশ সদস্য মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এসকর্টের দায়িত্বে ছিলেন, তাদেরকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাকিরা দায়িত্ব পালন করছেন আগের মতোই। পুলিশ ছাড়াও অন্যান্য সংস্থা ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পূর্বের ন্যায় পালন করছেন।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পুলিশ বাহিনীতে জনবলের সংকট রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি বেশকিছু দূতাবাস থেকে এসকর্ট সুবিধার জন্য অনুরোধ করার একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সে কারণে তাদের সবার সুবিধার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ আনসার বাহিনীতে একটি চৌকস দল তৈরি করেছে। বিদেশি কূটনীতিকরা তাদের খরচে এ সুবিধা নিতে পারবেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, সব ভিআইপির সুরক্ষা দেবে আনসারের প্রটেকশন গার্ড রেজিমেন্ট। এ উদ্দেশ্যে আনসার–ভিডিপিতে একটি প্রটেকশন গার্ড রেজিমেন্ট তৈরি করা হয়েছে। সব ভিআইপি, মন্ত্রী, মন্ত্রীদের বাসা এবং কেপিআইভুক্ত স্থাপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব আনসারদের দেওয়া হবে। কোনো রাষ্ট্রদূত চাইলে তাদেরও এ সুবিধা দেওয়া হবে। বিদেশি কূটনীতিকদের আনসার বাহিনী কীভাবে অতিরিক্ত নিরাপত্তা (এসকর্ট) দেবে, সেটি চূড়ান্ত হয়েছে।  ২১ মে’র মধ্যে নোট ভার্বালের (কূটনৈতিক পত্র) মাধ্যমে দূতাবাসগুলোকে বিষয়টি জানানো হবে। বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালকের সঙ্গে বৈঠক শেষে এ কথা জানান পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয়টি দেশের এসকর্ট সুবিধা প্রত্যাহার করায় এ ইস্যুতে কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ১৫ মে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে উপপ্রধান মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল কূটনীতিকদের সুরক্ষা ইস্যুতে ভিয়েনা কনভেনশন মনে রাখার পাশাপাশি মার্কিন কূটনৈতিক মিশন ও কর্মীদের নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে ব্রিফিংয়ের বিস্তারিত বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। বেদান্ত প্যাটেল আরও উল্লেখ করেন, কূটনৈতিক সম্পর্কের ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে, যেকোনো দেশকে অবশ্যই সব কূটনৈতিক মিশন প্রাঙ্গণ ও এর কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বাধ্যবাধকতাগুলো মেনে চলতে হবে এবং কর্মীদের ওপর কোনও আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য কার্যকর সব পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের কূটনৈতিক কর্মী এবং স্থাপনার নিরাপত্তা ও সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উল্লেখ্য, ভিয়েনা কনভেনশন মেনেই বাংলাদেশে সবসময় কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দেওয়া হবে। ভিয়েনা কনভেনশন শুধু ছয়টি দেশের জন্য নির্ধারিত নয়। সব দেশের কূটনীতিকদের জন্যই সমান। ভিয়েনা কনভেনশন এসকর্ট সুবিধা দিতেও বলে না, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলে। নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টি একেক দেশের জন্য একেক রকম। তাই বাংলাদেশে ছয়টি দেশের রাষ্ট্রদূতদের এসকর্ট প্রত্যাহারে কূটনীতিকদের নিরাপত্তায় ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘিত হবে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.