১৯৫০ সাল। তখনো কেউ জানত না, যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই ছিল স্নায়ুযুদ্ধ জয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি। সেই চাবিকাঠির নাম শিয়ান শ্যুসেন। তিনি ছিলেন প্রতিভাবান একজন চীনা রকেটবিজ্ঞানী, যিনি এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ ও অস্ত্রপ্রযুক্তিতে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (ক্যালটেক) ও ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) কর্মরত অবস্থায় শিয়ান জেটচালনার (জেট প্রপালশন) জটিল ধাঁধার সমাধান করেন। তাঁর গবেষণার ভিত্তিতেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম গাইডেড ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি হয়। তাঁকে কর্নেল পদে উন্নীত করে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীতে যুক্ত করা হয়।
এখানেই শিয়ান থেমে থাকেননি। তিনি গোপন ‘ম্যানহাটান প্রকল্পে’ কাজ করেছিলেন। সেখান থেকেই জন্ম নেয় বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁকে জার্মানিতে পাঠানো হয়েছিল নাৎসি বিজ্ঞানীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে। শিয়ানের স্বপ্ন ছিল, মহাকাশে প্রথম পা রাখবেন একজন আমেরিকান। সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে তিনি তখন একটি রকেট তৈরির কাজ করছিলেন।
ড. শিয়ান আর কোনো দিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাননি। জীবনের বাকি সময় তিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একজন খ্যাতিমান নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ চীনে তাঁকে জাতীয় বীর হিসেবে দেখা হয়, এমনকি তাঁর নামে একটি জাদুঘরও নির্মিত হয়েছে।
ঠিক তখনই থেমে গেল শিয়ানের উত্থানের পথ। ক্যারিয়ারের চূড়ায় পৌঁছানোর মুহূর্তে একদিন তাঁর দরজায় কড়া নাড়ে এফবিআই। স্ত্রী ও শিশুসন্তানের চোখের সামনে তাঁকে হাতকড়া পরানো হয়। শেষ পর্যন্ত আদালত রাষ্ট্রদ্রোহ ও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ থেকে তাঁকে মুক্তি দিলেও যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে আর ফিরিয়ে নেয়নি। ১৯৫৫ সালে এক ডজন মার্কিন যুদ্ধবন্দীর বিনিময়ে ড. শিয়ান শ্যুসেনকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কমিউনিস্ট–শাসিত বেইজিংয়ে।
এই একজন মাত্র ব্যক্তির নির্বাসনের পরিণতি ছিল বিপর্যয়কর। চীনে ফিরে শিয়ান শ্যুসেন সরাসরি মাও সে–তুংকে রাজি করান, তাঁকে কাজে লাগিয়ে যেন আধুনিক অস্ত্রপ্রযুক্তি কর্মসূচি গড়ে তোলা হয়। তার ঠিক এক দশক পর চীন তাদের প্রথম ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালায়।
আর ১৯৮০ সাল নাগাদ দেশটি এমন শক্তি অর্জন করে, যা দিয়ে চাইলেই ক্যালিফোর্নিয়া কিংবা মস্কোর ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো যায়। ড. শিয়ান শুধু চীনের ক্ষেপণাস্ত্র ও মহাকাশ কর্মসূচির জনকই নন, চীনে প্রযুক্তিগত বিপ্লবও তাঁর হাত ধরে শুরু হয়। একসময় যা চীনকে পরাশক্তিতে পরিণত করে।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের এই প্রতিবেদক উল্লেখ করেছেন, শিয়ানের জীবনের গল্প বারবার তাঁর মনে দাগ কেটেছে। তিনি বলেন, ‘আমি কয়েক বছর ধরে তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে একটি জীবনী লিখছি। এ সময়ে আমরা দেখেছি, ট্রাম্প প্রশাসন কতটা কঠোরভাবে বিদেশি শিক্ষার্থী ও গবেষকদের ওপর নজরদারি চালাচ্ছে।’
গত বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ঘোষণা দিলেন, প্রশাসন চীনা শিক্ষার্থীদের ভিসা ‘শিগগিরই বাতিল’ করার চেষ্টা করবে। বিশেষ করে যাঁরা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্কিত বা ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বিষয়ে পড়াশোনা করছেন, তাঁদের ওপর এ নিয়ম জারি করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ১০ লাখের বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী আছেন, যাঁদের মধ্যে ২ লাখ ৫০ হাজারের বেশি চীনা নাগরিক।
শিয়ান শ্যুসেনের নির্বাসনের গল্পটা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি সতর্কবার্তা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া এ সিদ্ধান্ত ভুল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বিদেশিদের প্রতি একধরনের ভীতি ও সন্দেহ থেকে যার সূত্রপাত ঘটেছিল। পরবর্তী সময়ে যেটা বিশ্বশক্তির ভারসাম্য চিরতরে বদলে দিয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতির মতো, তখনো শিয়ান শ্যুসেন সিনেটর জোসেফ ম্যাকার্থির ‘বাম ভীতি’র (রেড স্কয়ার) লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। এর কারণ একটাই, তিনি একজন চীনা নাগরিক ও বিজ্ঞানী ছিলেন। নিরাপত্তা অনুমোদন বাতিল হওয়ায় তিনি গভীরভাবে অপমানিত হন। ড. শিয়ানকে বাদ দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। এতে যুক্তরাষ্ট্র মানববাহী মহাকাশ অভিযানে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পেছনে ফেলার সুযোগ হারিয়েছিল। শুধু তা–ই নয়, একই সঙ্গে চীনারা এশিয়ায় আমেরিকান প্রভাব-প্রতিপত্তিকে চ্যালেঞ্জ করারও একটা সুযোগ পেয়ে যায়। শিয়ানের বদৌলতে চীনের বৈজ্ঞানিক ক্ষমতায় এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে।
‘যে জাতি বর্তমান প্রজন্মের চীনা তরুণদের শিক্ষিত করতে সফল হবে, সে জাতিই সবচেয়ে কম খরচে নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তারে সর্বোচ্চ ফল পাবে।’—
পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবধান ঘোচানোর পাশাপাশি ড. শিয়ানের দেশে প্রত্যাবর্তন চীনে বহু প্রজন্ম ধরে দেশীয় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও অগ্রগতির সূত্রপাত ঘটিয়েছে। আজও ওয়াশিংটন কোটি কোটি ডলার খরচ করে পারমাণবিক প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মিত্রদেশগুলোকে তার প্রযুক্তিগত অর্জন থেকে সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে।
সাবেক নৌবাহিনী সচিব ড্যান কিমবল ড. শিয়ানকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের বিষয়ে বলেছিলেন, ‘এটা ছিল এই দেশের করা সবচেয়ে বোকামির কাজ।’
১৯৬০-এর দশকে এই দর্শনের বাস্তব রূপ দেখা যায়। চীনের শীর্ষস্থানীয় ২০০ বিজ্ঞানীর তিন-চতুর্থাংশই তখন যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে নোবেল পুরস্কারও পান। এই শিক্ষাগত সেতুবন্ধের পেছনে ড. জেমসের বৃত্তি কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ড. শিয়ান মাত্র ২৩ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। তিনি যে বৃত্তি নিয়ে পড়তে এসেছিলেন, সেটি আজকের দৃষ্টিকোণ থেকে অতীতের মানসিকতার প্রতীক বলেই মনে হয়। আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রম মার্কিন মূল্যবোধ প্রচারে সহায়ক হবে এবং বিশ্বশান্তি গঠনে ভূমিকা রাখবে—এমন বিশ্বাস থেকে এ বৃত্তি দেওয়া হতো।
এই বৃত্তি তহবিল গড়ে তুলেছিলেন বেইজিংয়ে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি এডমন্ড জেমস। তাঁর উদ্যোগে ড. শিয়ানসহ আরও অনেক চীনা শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার সুযোগ পান। প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টকে লেখা এক চিঠিতে ড. জেমস লিখেছিলেন, ‘যে জাতি বর্তমান প্রজন্মের চীনা তরুণদের শিক্ষিত করতে সফল হবে, সে জাতিই সবচেয়ে কম খরচে নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তারে সর্বোচ্চ ফল পাবে।’
ড. শিয়ান ক্যালিফোর্নিয়ায় কিছু তরুণ, উদ্যমী ও প্রতিশ্রুতিশীল বিজ্ঞানীর সঙ্গে কাজ শুরু করেন। তাঁরা নিজেদের মজা করে ‘সুইসাইড স্কোয়াড’ বলে ডাকতেন। কারণ, রকেট পরীক্ষণের সময় অন্তত একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ল্যাব উড়ে গিয়েছিল।
প্রকৌশলীদের এক বার্ষিক সভায় ‘সুইসাইড স্কোয়াড’-এর দুই সদস্য ঘোষণা করেন, তাঁরা এমন একটি রকেট বানানোর পথ বাতলেছেন, যেটি পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে এক হাজার মাইল উঁচুতে সোজাসুজি উড়তে পারে। এরপর দ্রুতই তাঁদের দলকে আরেকটি আনুষ্ঠানিক নাম দেওয়া হয়, ‘দ্য জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি’।
১৯৪৯ সালে ড. শিয়ানকে ওই ল্যাবরেটরির প্রধান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। এটি তখন নাসার প্রাথমিক সংস্করণ হিসেবে পরিচিত ছিল। তিনি শুধু যুক্তরাষ্ট্রকে মহাকাশ প্রতিযোগিতায় এগিয়ে নিতে চাননি, বরং রকেট প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত বিমানযাত্রার পরিকল্পনাও সামনে এনেছিলেন। যার মাধ্যমে যাত্রীরা নিউইয়র্ক থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসে এক ঘণ্টারও কম সময়ে পৌঁছাতে পারবেন।
ড. শিয়ান কি গুপ্তচর ছিলেন? তিনি কি কমিউনিস্ট ছিলেন? এই দাবি দুটির কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ ছিল না। তবে মার্কিন সরকার আদৌ এসব নিয়ে ভেবেছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ম্যানহাটান প্রকল্পে ড. শিয়ানের সঙ্গে কর্মরত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জে রবার্ট ওপেনহেইমারসহ উচ্চপদস্থ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা এবং অনেক শিক্ষাবিদ বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও ফল মেলেনি। পাঁচ বছর গৃহবন্দী থাকার পর ড. শিয়ান যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের হওয়ার জন্য চীনা সরকারের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রকাশিত গোপন নথিপত্র থেকে জানা যায়, একপর্যায়ে আইজেনহাওয়ার প্রশাসনের চোখে ড. শিয়ান শ্যুসেন অবমূল্যায়িত এক দাবার ঘুঁটিতে পরিণত হয়েছিলেন। শেষমেশ তাঁকে কয়েকজন মার্কিন পাইলটের বিনিময়ে চীনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এই বিনিময় নিয়ে চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চৌ এনলাই বিজয়ের উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা শিয়ান শ্যুসেনকে ফিরিয়ে এনেছি, এই একটি অর্জনই পুরো আলোচনাকে সার্থক করেছে।’
ড. শিয়ান আর কোনো দিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাননি। জীবনের বাকি সময় তিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একজন খ্যাতিমান নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ চীনে তাঁকে জাতীয় বীর হিসেবে দেখা হয়, এমনকি তাঁর নামে একটি জাদুঘরও নির্মিত হয়েছে।
জীবনের শেষভাগে শিয়ানের মন্তব্যগুলোর বেশির ভাগ ছিল প্রযুক্তিগত নথিপত্র কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দলীয় প্রচার নিয়ে। তবে ১৯৬৬ সালে ক্যালটেকের এক পুরোনো সহকর্মী একটি পোস্টকার্ড পান। বেইজিং থেকে পাঠানো সে পোস্টকার্ডের ওপর ছিল ঐতিহ্যবাহী চীনা ফুলের একটি নকশা। সেখানে ড. শিয়ান একটিমাত্র বাক্যই লিখেছিলেন—‘এটি সেই ফুল, যা প্রতিকূল পরিবেশেও ফোটে।’
যদিও মার্কো রুবিওর ঘোষণায় বিস্তারিত তেমন কিছু ছিল না, তবু এটি গবেষণাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ল্যাবগুলোর আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ও তাঁদের সহকর্মীদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। এ কারণে সবাই আশঙ্কা করছেন, সামনে আরও অস্থিরতা আসতে পারে।
তবে শুধু উদ্বেগ নয়, এর মাধ্যমে আরও একটি বড় কিছু হারিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র একসময় বিশ্বাস করত, বিশ্বের মেধাবী ও পরিশ্রমী তরুণদের শিক্ষাদান এই দেশের শক্তি ও মর্যাদা বাড়ায়। এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি কৌশলগত সুবিধা। বিশ্বের সেরা চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী ও ভবিষ্যৎ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসতেন। এখানকার গণতন্ত্র ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতেন। এই সুযোগটাই এখন হারিয়ে যাচ্ছে।
চীনের জন্য ড. শিয়ান শ্যুসেনের অর্জিত সাফল্যগুলো দেখিয়ে দেয়, যদি আমরা বিশ্বের মেধাবীদের স্বাগত না জানিয়ে দূরে সরিয়ে দিই, তাহলে বড় সুযোগ হারিয়ে ফেলব। এমনকি ওই মেধা একদিন আমাদের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা হতে পারে। তাই এটা একটা বড় ঝুঁকি, যা ভবিষ্যতে ক্ষতির কারণ হতে পারে।
নিউইয়র্ক টাইমস