যেসব কারণে তিন আইনের সংশোধন চায় পুলিশ

আইনমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠক

0
171
বাংলাদেশ পুলিশ

যুক্তরাজ্য তার উপনিবেশগুলোর জন্য ১৮৬৭ সালের পাবলিক গ্যাম্বলিং আইন করেছিল। প্রকাশ্যে জুয়া আইনটি জুয়া দমনের আইন হলেও বাংলাদেশে এটি অস্পষ্ট। ২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় এই আইনটির ‘অকার্যকারিতার’ বিষয়টি সামনে আসে। ওই বছর ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি ক্যাসিনোতে অভিযানের পর সিলগালা ও অনেককে আটক করা হয়। তবে তাদের বিরুদ্ধে ‘জুয়া খেলার’ অপরাধে মামলা হয়নি। সব মামলা হয়েছে মাদক, মানি লন্ডারিং ও অস্ত্র আইনে। এসব আইনে শাস্তি বেশি। আর জুয়া আইনে ‘ক্যাসিনো’ বলে কোনো শব্দ নেই। তাই জুয়া আইনে পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগও ছিল না। এবার পুলিশের পক্ষ থেকে যুগোপযোগী জুয়া আইন তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছে। পুলিশ সপ্তাহের পঞ্চম দিনে গতকাল রোববার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছে। সভায় আইন সচিব ও পুলিশ মহাপরিদর্শকও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে দেড়শ বছরের পুরোনো জুয়া আইনের সংশোধন অথবা জুয়া প্রতিরোধে নতুন একটি আইন করার প্রয়োজনীয়তার কথা পুলিশের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়। এই আইনে অনলাইন জুয়া প্রতিরোধের বিষয় যুক্ত করার কথাও বলা হয়েছে। এ ছাড়া শ্রম আইন ও নিরাপদ খাদ্য আইনেরও সংশোধন চাওয়া হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বৈঠকে উপস্থিত একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, জুয়া খেলার ধরন বদলে গেছে। এখন অনলাইনে জুয়া খেলার প্রবণতা বেশি।

অ্যাপসের মাধ্যমে অনেকে জুয়া খেলছেন। অধিকাংশ সময় বিট কয়েনসহ ভার্চুয়াল মুদ্রার মাধ্যমে জুয়ার অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। আবার বিভিন্ন খেলা চলাকালে অনলাইনে জুয়ার আসর বসে। ১৮৬৭ সালের জুয়ার আইন দিয়ে বর্তমানে জুয়াকেন্দ্রিক যে অপরাধ, তা প্রতিরোধ করা অসম্ভব। ১৮৬৭ সালের প্রকাশ্য জুয়া আইনে কেউ তার ঘর, তাঁবু, কক্ষ, প্রাঙ্গণ বা প্রাচীরবেষ্টিত স্থানের মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী বা ব্যবহারকারী হিসেবে যে কোনো ব্যক্তি জ্ঞাতসারে বা স্বেচ্ছায় অন্য লোককে, উক্ত স্থানকে সাধারণ জুয়ার স্থান হিসেবে ব্যবহার করতে দিলে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। তবে বর্তমানে অনলাইনে কোটি কোটি টাকার জুয়ার অর্থ স্থানান্তর হয়। পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্য, ব্রিটিশ আমলে আইনটি করা হয়েছিল ওই সময়ের বাস্তবতায়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশ ক্যাসিনোর মতো বিষয়ে যুগোপযোগী পূর্ণাঙ্গ আইন করেছে। বাংলাদেশেও এই ধরনের আইন প্রয়োজন।

তবে বিশ্বের কিছু দেশে জুয়া বৈধ। মালয়েশিয়ায় সীমিতভাবে জুয়ার বৈধতা দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৬ সালের ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশে জুয়ার বিষয়ে দুটি ধারা আছে। ৯২ ধারা বলেছে, যারাই জুয়া খেলার উদ্দেশ্যে সড়ক বা পাবলিক প্লেসে (জনসমাগমস্থল) একত্রিত হবে, তাদের অনধিক ১০০ টাকা জরিমানা করা যাবে। ৯৩ ধারা বলছে, গণবিনোদনে কেউ কোনো খেলায় যুক্ত হলে, তাকে অনধিক ২০০ টাকা জরিমানা করা যাবে। জুয়ার নতুন আইনের বিষয়টি পুলিশের পক্ষ থেকে তোলা হলে আইনমন্ত্রী এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন বলে জানা গেছে।

এ ছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, শিল্প পুলিশ দেশের বিভিন্ন শিল্প এলাকায় নিয়োজিত রয়েছে। শ্রমিক অসন্তোষ মোকাবিলাসহ শিল্প এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখছে তারা। তবে শ্রম আইনে শিল্প পুলিশের বিষয়টি উল্লেখ করা নেই। শ্রম আইন ও খাদ্য আইনে পুলিশের কাজের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব আসে।

এ ছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়- মামলায় সারা বছরই আদালতে হাজির হয়ে পুলিশকে সাক্ষী দিতে হয়। এমনকি কোনো পুলিশ সদস্য অবসর নেওয়ার পর কোনো মামলায় সাক্ষী হিসেবে নাম থাকলে বছরের পর বছর তাঁকে আদালতে হাজির হতে হয়। অবসরে নিজ খরচে আদালতে হাজির হয়ে অনেকে সাক্ষী দিতে চান না। আবার পুলিশের সাক্ষীদের অধিকাংশ এসআই ও এএসআই। অবসরের পর তাঁরা গ্রামের বাড়ি চলে যান। তবে মামলার সাক্ষী দিতে দেশের বিভিন্ন আদালতে যেতে হচ্ছে। অবসরের পর যে পুলিশ সদস্য মামলার সাক্ষী দেবেন, তাঁদের যাতায়াত খরচের জন্য ভাতা প্রস্তাব করে পুলিশ।

আইনমন্ত্রী ছাড়াও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে গতকাল পূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেনের পৃথকভাবে বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবরাও ছিলেন।

বৈঠকে পুলিশের পক্ষ থেকে মেট্রোরেলের নিরাপত্তার জন্য আলাদা পুলিশ ইউনিট ও সাইবার ক্রাইম ইউনিটের প্রস্তাব করা হয়েছে। পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, মেট্রোরেলের নিরাপত্তার জন্য স্বতন্ত্র ‘মেট্রোরেল পুলিশ’ ইউনিটের প্রস্তাব পুলিশের পক্ষ থেকে আগেই মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। সচিব কমিটির সভায় একাধিকবার বিষয়টি ওঠে। তবে এরই মধ্যে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ নিজেরা নিরাপত্তা ইউনিট গঠনের চিন্তাভাবনা শুরু করেছিল। নিজেরা লোকবল নিয়োগ করার পর মেট্রোরেলের নিরাপত্তা তাদের তদারকিতে করার প্রস্তাব তারা দিয়েছিল। কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে যুক্তি তুলে ধরা হয়- মেট্রোরেলকেন্দ্রিক কোনো অপরাধ হলে সেটার নিয়ন্ত্রণ করার আইনি এখতিয়ার পুলিশের। শেষ পর্যন্ত মেট্রোরেলের নিরাপত্তায় পুলিশের স্বতন্ত্র ইউনিট কাজ করবে বলে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে এর জন্য জনবল চাওয়া হয়েছে ৩৮৩ জন।

এ ছাড়া পুলিশের জন্য গ্রেড-১ পদ ১০টি, পুলিশ মহাপরিদর্শকের পদ ‘ফোর স্টার জেনারেলের’ (সেনাপ্রধান) পদের সমান করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার হওয়ায় আর্থিক বিষয়ে আইজিপিকে আর্থিক সাচিবিক ক্ষমতা দেওয়ার কথাও বলা হয়। এ ছাড়া ঢাকায় ডিএমপি কমিশনারের জন্য বাড়ি, সময় মতো পদোন্নতির বিষয় তুলে ধরা হয়। এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানের সঙ্গে বৈঠকেও পুলিশের পক্ষ থেকে পুলিশ অধিদপ্তরকে ‘সদরদপ্তর’ করা, পুলিশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, স্বতন্ত্র পুলিশ প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, পুলিশে সিভিল স্টাফদের আজীবন রেশন দেওয়ার দাবি তোলা হয়। এ ছাড়া পুলিশের আলাদা মেডিকেল কোর ও পরিবহন সংকটের কথা তুলে ধরা হয়।

সাহাদাত হোসেন পরশ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.