জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলায় সাংবাদিক গোলাম রব্বানি নাদিম হত্যার ঘটনার একটি বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর সহকর্মী ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আল মুজাহিদ। ঘটনার দিন গত বুধবার রাত সোয়া ১০টার দিকে তিনি গোলাম রব্বানির সঙ্গে উপজেলার পাটহাটি মোড় দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। দুজনকে আলাদা দুটি মোটরসাইকেলে করে যেতে সিসিটিভির ফুটেজেও দেখা গেছে। একটি বাইকে থাকা সাংবাদিক রব্বানিকে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে পেটাতে পেটাতে সিসিটিভির আওতার বাইরে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। এরপরের ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা দিয়েছেন আল মুজাহিদ।
আল মুজাহিদ ‘জবাবদিহি’ ও ‘দেশ বাংলা’ নামের স্থানীয় দুটি পত্রিকার বকশীগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। সাংবাদিক গোলাম রব্বানির সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। আল মুজাহিদ বলেন, সন্ত্রাসীরা প্রথমে ব্যস্ততম এলাকায় চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে টেনেহিঁচড়ে সাংবাদিক গোলাম রব্বানিকে নামায়। তাঁকে উপর্যুপরি কিল-ঘুষি দিতে দিতে অন্ধকার টিঅ্যান্ডটি সড়কে নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিল আরও ১৫–২০ জন সন্ত্রাসী। সবাই মিলে যে যেভাবে পারছিল, রব্বানিকে পেটাচ্ছিল। আর দূর থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন মূল অভিযুক্ত সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা মাহমুদুল আলম ওরফে বাবু। একপর্যায়ে কেউ একজন লাথি মেরে পাশে থাকা একটি দেয়ালের ইট ভাঙে। চেয়ারম্যানের ছেলে সেই ইট হাতে নিয়ে রব্বানিকে আঘাত করেন। সাংবাদিক গোলাম রব্বানি বারবার বাঁচার জন্য কাকুতি-মিনতি করছিলেন। তবু তাঁকে নির্মমভাবে মারছিল তারা। একপর্যায়ে মৃত ভেবে তাঁকে ফেলে সবাই চলে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংবাদ প্রকাশকে কেন্দ্র করে সাংবাদিক গোলাম রব্বানির ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম। বিভিন্ন সময় তিনি গোলাম রব্বানিকে হুমকি দিয়েছেন। ঘটনার দিন বুধবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত গোলাম রব্বানি মেয়ের ভর্তির কাজে ময়মনসিংহে ছিলেন। বিকেলে বাড়িতে ফিরে সন্ধ্যার পর তাঁর কার্যালয়ে যান। কার্যালয় থেকে বেরিয়ে পাশের একটি দোকানে পান খেতে যান। সেখানেই দেখা হয় সহকর্মী আল মুজাহিদের সঙ্গে। সেখানে কিছুক্ষণ গল্প করে আলাদা মোটরসাইকেলে তাঁরা বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। তাঁরা পাশাপাশি মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিলেন। এ সময় পাটহাটি মোড়েই রব্বানিকে বাইক থেকে টেনেহিঁচড়ে নামায় দুর্বৃত্তরা।
সাংবাদিক আল মুজাহিদ বলেন, ওই চেয়ারম্যান পূর্বপরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। কারণ, ওই মোড়ের উত্তর দিকে টিঅ্যান্ডটি সড়কে ওই চেয়ারম্যান আরও লোকজন নিয়ে অবস্থান করছিলেন। সেই হিসেবে তাঁকে (সাংবাদিক রব্বানি) মারতে মারতে টিঅ্যান্ডটি সড়কে নিয়ে যাওয়া হয়। আর ওই সড়ক কিছুটা অন্ধকার ছিল। সেখানে ১৫–২০ জন নির্মমভাবে তাঁকে মারে। ওই সড়ক ধরেই ওই চেয়ারম্যানের বাড়িতে যাওয়া যায়। ফলে তাঁরা সড়কটিকে বেছে নিয়েছিল বলে মনে হচ্ছে। যখন তিনি (রব্বানি) অচেতন হয়ে পড়েন, তখন তাঁকে মৃত ভেবে ওই সড়ক দিয়ে চেয়ারম্যানের বাড়িতে সবাই চলে যায়।
আল মুজাহিদ আরও বলেন, ‘আমি গোলাম রব্বানিকে মামা ডাকতাম। তাঁকে যখন এভাবে মারা হচ্ছিল, আমি এগিয়ে যাই। তাঁরা আমাকেও হত্যার হুমকি দেয়। আমি প্রাণভয়ে কিছুই করতে পারিনি। তখন আমি আমাদের লোকজনকে ফোন করে আসতে বলি।’
প্রত্যক্ষদর্শীর এই সাংবাদিকের বক্তব্যের বিষয়ে বকশীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোহেল রানা বলেন, ‘মুজাহিদ আমাদের এই ধরনের কোনো ভাষ্য দেননি। আমাদের কাছে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ আছে এবং ঘটনার সময় আশপাশে আরও লোকজন ছিলেন। ফলে তদন্তের মাধ্যমে এই ঘটনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা সবাই শনাক্ত হবেনই। আমরা ইতিমধ্যে ছয়জনকে আটক করেছি। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ফলে এই ঘটনার পেছনের এবং সামনের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।’
ঘটনার পর থেকে অভিযুক্ত চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা পলাতক থাকায় অভিযোগের বিষয়ে কারও বক্তব্য নেওয়া যায়নি।