সৎভাবে, স্বচ্ছ থেকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো যায়

0
160
বিকাশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা(সিইও) কামাল কাদীর

দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইলে আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান বিকাশের এক যুগ পূর্ণ হচ্ছে আজ, ২১ জুলাই। এই ১২ বছরের অগ্রযাত্রা, অভিজ্ঞতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ নানা বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বিকাশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা(সিইও) কামাল কাদীর। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শওকত হোসেন।

মালিকানায় অংশীদারত্ব: ব্র্যাক ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানি ইন মোশন এলএলসি, ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি), বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, আলিবাবা গ্রুপের সহযোগী অ্যান্ট গ্রুপ ও জাপানের সফটব্যাংক ভিশন ফান্ড

১২ বছর আগে যখন শুরু করলেন, কী ছিল মাথায়?

কামাল কাদীর: বিকাশ দিয়ে আসলে একজন গ্রাহক কত টাকা লেনদেন করছেন, সেটি বড় বিষয় নয়। ১ টাকা ৩০ পয়সা আর ১ লাখ ৩০ টাকা লেনদেনের মধ্যে প্রযুক্তির দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ প্রযুক্তি একই। সুতরাং শুরু থেকেই জানতাম, বড় মাত্রার এ রকম একটি সেবা খাত পরিচালিত করতে খুবই বিশ্বাসযোগ্য একটা প্ল্যাটফর্মে আমাদের যেতে হবে।

প্রথম থেকেই আমাদের মাথায় ছিল গুণগত মানে দক্ষ হতে হবে এবং পরিচালিত হতে হবে নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামোর মধ্যেই। এই যে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার ওপর আস্থা রেখে এগোনো, এটা খুবই প্রয়োজনীয়। আর বাংলাদেশের ওপর অগাধ আস্থা ছিল। ফলে এখন পর্যন্ত আমরা একজন বিদেশিকেও নিয়োগ দিইনি। দেশে আসলে মেধার অভাব নেই।

বিকাশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল কাদীর
বিকাশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল কাদীর

যখন এক দশক হলো, বিকাশের সঙ্গে তখন বিস্তারিত কথা হয়েছিল। আর এবার তো এক যুগ হচ্ছে বিকাশের বয়স। ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে পার্থক্য কী?

কামাল কাদীর: কয়েকটি বিষয় নিয়ে এ সময় আমরা কাজ করেছি। খরচের বিষয়টি ভাগ ভাগ করার উদ্যোগ নিয়েছি। যেমন কেউ অনেক ব্যবহার করলে একধরনের খরচ হবে। আর ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় বা ক্যাটাগরিতে ব্যবহার করলে আরেক ধরনের খরচ হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রিয় গ্রাহক, প্রিয় এজেন্ট—এ রকম বেশ কিছু ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। এটা বড় ধরনের প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ। এখন একজন গ্রাহক এমন পাঁচজনকে বাছাই করতে পারেন, যাঁদের কাছে বেশিবার টাকা পাঠানো হয়। এ ক্ষেত্রে টাকা পাঠাতে কোনো ব্যয় নেই। একইভাবে একজন এজেন্টকে বাছাই করলেও টাকা ক্যাশ আউটের ব্যয় ১৮ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১৪ টাকা ৯০ পয়সায় চলে আসবে। আমরাও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখেছি, গ্রাহকের বড় অংশই পাঁচজনের বেশি আসলে টাকা পাঠান না। সুতরাং পাঁচজনকে বাছাই করার সুবিধা দেওয়া হলে বেশির ভাগ মানুষকে উপকৃত করা যাবে। ৯০ শতাংশ লেনদেন এই ৫ জনের মধ্যেই হয়। ৬ জন হলে সেটা হয় ৯৯ শতাংশ, তবে তাতে অপব্যবহারের পরিমাণ বেশি হবে। এ জন্যই ৫ জনের ক্ষেত্রে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থ পাঠাতে এই বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এতে কিন্তু ৯৯ শতাংশ গ্রাহকই খুশি। আর যাঁর আসলে অনেক বেশি লেনদেন করা দরকার, সে কিন্তু বিনা মূল্যে সেবা নিয়ে বাড়তি সেবার জন্য ব্যয় করছেন।

এর অর্থ হলো খরচ কমানো আপনাদের একটি বড় লক্ষ্য?

কামাল কাদীর: বিকাশ একটি বর্ধনশীল কোম্পানি। গ্রাহকের খরচ বাড়িয়ে আমাদের কোনো লাভ হবে না; বরং তাতে গ্রাহক অসন্তুষ্ট হবেন। সুতরাং গ্রাহকদের সন্তুষ্ট রাখতে আমরা খরচ কমানোর উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছি।

বিকাশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল কাদীর
বিকাশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল কাদীর

প্রতারণার কথাও অনেক শোনা যায়। এ নিয়ে কী করছেন?

কামাল কাদীর: প্রতারণা কিন্তু সব ধরনের প্রতিষ্ঠানেই হয়। তবে এ নিয়ে অনেকেই কথা বলতে চান না। আমরা এটা বলি। এটাই বিকাশের শক্তির জায়গা, যা আমাদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে। তা ছাড়া আমাদের তো ১২ বছর হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং মানুষজন এখন বিষয়গুলো পরিপক্বতার সঙ্গেই দেখছেন। আমরা যখন আমাদের ব্র্যান্ড নিয়ে সমীক্ষা করি হাজার হাজার গ্রাহককে নিয়ে, তখন তাঁরা বলছেন যে বিকাশকে পছন্দ করেন; কারণ, বিকাশ বলে দেয়, কোথায় বিপদ, কী করলে নিরাপদ থাকা যাবে। কোনো কিছু লুকানোর প্রবণতা বিকাশের নেই।

বিকাশ তো এখন ঋণ দিচ্ছে। অভিজ্ঞতা কেমন?

কামাল কাদীর: পণ্যের দিক থেকেও আমরা আর্থিক সেবাকে বহুমুখী করেছি। আগে ছিল, একজন গ্রাহক বিকাশের মাধ্যমে নিজের হিসাবে টাকা এনে তা বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করতে পারতেন। এখন গ্রাহকেরা বিকাশের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও অন্তর্ভুক্ত হতে পারছেন, ঋণ নিতে পারছেন। সঞ্চয়ও করতে পারছেন। আমরা ডিজিটাল ঋণ চালু করেছি। আজ থেকে সাড়ে তিন বছর আগে ডিজিটাল ঋণ কীভাবে চালু করা যেতে পারে, এ নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, আমরা ও একটি তফসিলি ব্যাংক আলোচনা শুরু করেছিলাম। সে সময় নিয়ন্ত্রকের পক্ষ থেকেই বলা হলো, দুটো দেশ সফর করে দেখা যাক, তারা কাজটা কীভাবে করে, ঝুঁকি কীভাবে কমাচ্ছে, ডিজিটাল ঋণ নিয়ে কেউ অপব্যবহার করলে সেটা কীভাবে থামানো হচ্ছে। আমরা কেনিয়া আর তানজানিয়া ঘুরে এ বিষয়ে অনেক কিছু শিখলাম। ফিরে আসার পর বাংলাদেশ ব্যাংক বলল, এক বছরের জন্য একটা পাইলট প্রকল্প করে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করে নিতে। সেটা করে আমরা আরও কিছু জিনিস শিখলাম। এরপর দেড় বছর আগে সিটি ব্যাংকের সঙ্গে আমরা বাণিজ্যিকভাবে প্রথম ডিজিটাল ঋণ চালু করেছি। এই ঋণের সীমা ২০ হাজার টাকামাত্র। যাঁরা এই ঋণ নিচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই আর্থিকভাবে সচ্ছল নন। আবার খেলাপির পরিমাণও অনেক কম, শুরু থেকে এখন পর্যন্ত গড় করলে এই হার ১ শতাংশের কম।

এই ঋণ দেওয়ার জন্য গ্রাহকদের একধরনের তালিকা করা হয়েছে। ডিজিটাল কেওআইসি (নিজের গ্রাহককে জানো) আছে এবং লেনদেনের ধরনের ভিত্তিতে একটা অ্যালগারিদম করা হয়। তারই ভিত্তিতে সিটি ব্যাংক তাদের সহনশীল মাত্রার মধ্যে থেকে ঋণ দিচ্ছে। এখন তিন মাসের জন্য ঋণ দেওয়া হচ্ছে। প্রতি মাসে কিস্তি হিসেবে অর্থ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যাংকে জমা হয়ে যায়। কেটে রাখা হয়। কেউ কিস্তি পরিশোধ করতে বিলম্ব করলে ফোন করা হয়, টেক্সট বার্তা দেওয়া হয়। তাতেই ফল খারাপ না। এরই মধ্যে ২৭৫ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়েছে।

গত ১২ বছরে কয়েকটি মৌলিক কাজ করার চেষ্টা করেছি। যেমন গ্রাহকের অর্থের নিরাপত্তা কী করে হবে, সেই কাঠামো কেমন হবে; কোম্পানি যাঁরা করছেন, তাঁদের দেখাশোনা করা; কাজ করার জন্য এমন একটা প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করা, যেন সেরা মেধা এখানে কাজ করতে আকৃষ্ট হয় ইত্যাদি। এ ধরনের অসংখ্য উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছি।

১২ বছর, ৭ কোটি গ্রাহক, দিনে ১ কোটি ২০ লাখ লেনদেন—আপনার কাছে ম্যাজিক ফিগার কোনটা?

কামাল কাদীর: আসলে সংখ্যা বড় বিষয় নয়। আমার নিজস্ব একটা লিটমাস স্কেল আছে। যেমন ধরেন, সকালে স্টার হোটেলে নাশতা করতে গেছি। সেখানে যিনি খাবার দিচ্ছেন, তাঁকে প্রশ্ন করি, বাড়িতে কীভাবে টাকা পাঠান। তাঁরা গ্রামের বাড়িতে মা–বাবার কাছে বিকাশেই টাকা পাঠান। এটা অবশ্যই একটা অর্জন। কিন্তু যখন জিজ্ঞেস করি, কেনাকাটার সময় অর্থ পরিশোধ কীভাবে করেন। তখন জানতে পারি, নগদ টাকায়। সুতরাং দেখছি যে বিকাশে টাকা রাখা ও পাঠানো যায়, এতে অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু জীবনকে সহজ করার জন্য বিকাশ যে আরও নানাভাবে ব্যবহার করা যায়, সেটায় সব শ্রেণির মানুষ এখনো পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি। আমাদের লক্ষ্য এখন এটাই।

আমরা দেখেছি, এখন প্রতিদিন বিকাশে যে ১ কোটি ২০ লাখ লেনদেন হয়, এর ৭৫ শতাংশই ডিজিটাল লেনদেন। বিকাশের মাধ্যমে কথা বলার জন্য মোবাইলে রিচার্জ করছেন, টাকা পাঠাচ্ছেন, কোনো কিছুর মূল্য পরিশোধ করছেন বা পরিষেবার বিল দিচ্ছেন। সুতরাং এই যে ডিজিটাল লেনদেনের অভ্যাস তৈরি হয়েছে, এটা কোনোভাবেই কম নয়।

বিকাশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল কাদীর
বিকাশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল কাদীর

বিকাশ নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?

কামাল কাদীর: আসলে স্বপ্নের কোনো শেষ নেই। স্বপ্ন চলমান একটা জিনিস। আগামী দুই বছরের মধ্যে দেশের বিশাল জনসংখ্যার একটি বড় অংশই বিকাশ ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের মূল্য পরিশোধ করছে, এটা দেখাই এখন আমার স্বপ্ন। আমি আগেও বলেছি, ডিজিটাল লেনদেন যত বাড়বে, খরচ তত কমে আসবে। এটা কিন্তু আজ বাস্তবতা। এখন ৫০ লাখের বেশি মানুষ প্রতি মাসে বিকাশ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের সেবা ও পণ্যর মূল্য পরিশোধ করছেন।

আপনি একটি কথা বেশ জনপ্রিয় করেছেন। সেটি হলো মানব এটিএম। এটা কেন বলেন?

কামাল কাদীর: আজ থেকে ১২ বছর আগে যখন কাজ শুরু করি, তখন বাংলাদেশের শতভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল না, যা এখন হয়েছে। এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে হয়তো অনেক বেশি এটিএম মেশিন বসানো সম্ভব। তবে এটা অনেক বড় বিনিয়োগের বিষয়। তা না করে এমন একটা ব্যবস্থা করা যায়, যার মাধ্যমে এটিএম বসানোর লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব। আমাদের বিকাশের হয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা তো এটিএম মেশিনেরই কাজ করছে। এটিএম মেশিন থেকে মানুষ টাকা তোলেন। আর আমাদের যে মানব এটিএম, তিনি টাকা দিচ্ছেন, আবার নিচ্ছেনও।

আর এর মাধ্যমে আমরা যে ৩ লাখ ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছি, সেটা একটা বড় পাওয়া। কেবল কর্মসংস্থানই নয়, এটিএমের জন্য বিদ্যুৎ ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যে প্রয়োজন হয়, এ ক্ষেত্রে তারও প্রয়োজন নেই। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নতুন কোনো যন্ত্র বসানোরও দরকার পড়ে না। সুতরাং মানব এটিএম আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে একটা খুব কার্যকর ব্যবস্থা। আমাদের তো মানবসম্পদ আছেই। সুতরাং মানব এটিএম আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে একটা খুব কার্যকর ব্যবস্থা।

অর্থের নিরাপত্তা নিয়ে কী করেছেন?

কামাল কাদীর: টাকা কিন্তু আমাদের কাছে এখন থাকে না। টাকা থাকে সরকারি সিকিউরিটিজে। আইনে বলা হয়েছে, আমাদের ন্যূনতম ২৫ ভাগ অর্থ সরকারি সিকিউরিটিজে রাখতে হবে। তবে সবাই জেনে আশ্বস্ত হবেন যে এই মুহূর্তে বিকাশের ৭৭ শতাংশ অর্থ সরকারি সিকিউরিটিজে রাখা আছে। এটাই সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা। বাকি যে ২৩ শতাংশ, তা রাখা আছে আমাদের পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে ঠিক করা এক নীতি দ্বারা তৈরি একটা কাঠামোর আওতায়। যেমন ব্যাংকের ঋণ অনুপাত, তার আর্থিক স্বাস্থ্য—এসব বিষয়ে একটি প্যারামিটার ঠিক করা আছে। সেই অনুযায়ী ভালো ভালো ব্যাংকে অর্থ রাখা আছে।

বিকাশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল কাদীর
বিকাশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল কাদীর

বিকাশ কি লাভজনক হতে পেরেছে?

কামাল কাদীর: শুরুর দিকে যেকোনো প্রযুক্তিভিত্তিক কোম্পানিকে পণ্য, পরিষেবা ও প্রযুক্তির উন্নতির জন্য ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ করতে হয়। ফলে প্রথম কয়েক বছর লাভ আসবে না, এটাই স্বাভাবিক। তবে এরপর চার বছর কিছুটা লাভ করেছে বিকাশ। তবে যে আয় হয়েছে বা রাজস্ব এসেছে, তা দিয়ে সেবার মান বাড়াতে বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং সে বিনিয়োগের অঙ্কটা বেশ বড় ছিল। লাভের দিকে না তাকিয়ে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিনিয়োগ করা হয়েছে। সেই বিনিয়োগের সুফলই এখন পাওয়া যাচ্ছে। গত বছরও বিকাশ কিছু পরিমাণ মুনাফা করেছে।

ডিজিটাল ব্যাংকের গাইড লাইন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে আপনাদের কী পরিকল্পনা?

কামাল কাদীর: ডিজিটাল ঋণ নিয়ে সাড়ে তিন বছর ধরে আমরা চর্চা করছি। এ নিয়ে শিখেছি অনেক এবং এখনো শিখছি। আবার আমাদের শেয়ারহোল্ডার যারা আছে, তাদের মধ্যে সেরা ডিজিটাল ব্যাংক পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে। খরচ কমিয়ে, ডিজিটাল অবকাঠামো ব্যবহার করে এই ডিজিটাল ব্যাংক সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। বিকাশের সম্পৃক্ততা আছে ব্র্যাক ব্যাংক, আইএফসি, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, অ্যান্ট গ্রুপ ও সফটব্যাংক ভিশন ফান্ডের সঙ্গে। এই সম্পৃক্ততা বিকাশকে সর্বদাই একটা শক্তি দিয়েছে। বিকাশ ব্র্যাক ব্যাংকের কাছ থেকে বাজারে সঠিক ইন্টারভেনশন শিখেছে; গভর্ন্যান্স ব্যবস্থা কীভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের ডিএনএতে থাকতে হবে, তা শিখেছে আইএফসির কাছ থেকে; বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে শিখেছে অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক উপকরণের নানা দিক। একটা উদাহরণ দিই, শুরুতে আমাদের সব টাকা একটি ব্যাংকে রাখা হতো। আমাদের শেয়ারহোল্ডাররা বলল, এভাবে একটা ব্যাংকে সব অর্থ রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। পরে আমরা ব্যাংকের সংখ্যা বাড়িয়েছি। অ্যান্ট গ্রুপ দিয়েছে দারুণ সব প্রযুক্তিগত ধারণা, সফটব্যাংক পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে এমন সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে, যারা খুব ভালোভাবে ডিজিটাল ঋণ ও ডিজিটাল প্রযুক্তির সেবা ব্যবহার করছে। এভাবেই বিকাশ সারা দুনিয়া থেকে শিখে নিয়ে দেশে চর্চা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকের গাইডলাইন প্রকাশ করেছে। আমরাও বিষয়টি গভীরভাবে নজরে রাখছি। সুতরাং যদি আমাদের শেয়ারহোল্ডাররা সুযোগ পায়, তাহলে আমরা যা যা শিখতে পেরেছি, তা বাংলাদেশে সঠিকভাবে ব্যবহার করার সুযোগ পাব।

একটা কথা বিনয়ের সঙ্গে বলি, বিকাশ এ দেশে ৩৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে। আমরা ডিজিটাল ঋণ দিচ্ছি আরেকটি ব্যাংককে সঙ্গে নিয়ে। এখন বিকাশের শেয়ারহোল্ডাররা যদি এই সুযোগ পায়, তাহলে আরও বিনিয়োগ আনার পাশাপাশি দক্ষতার সঙ্গে, কম খরচে ডিজিটাল ঋণ দেওয়া যাবে। সুতরাং ডিজিটাল ব্যাংক তৈরি করতে পারলে সেটা হবে আমাদের জন্য দারুণ একটা সুযোগ।

বিকাশের ১২ বছরে কী বার্তা বা মেসেজ দিতে চাচ্ছেন?

কামাল কাদীর: ‘শেকড় আমার জন্মভূমি, আমার বিকাশ ঠেকায় কে’—এটাই এখন আমাদের বার্তা। এর আগে আমরা এ ধরনের শব্দ কখনো ব্যবহার করিনি। এবার করছি। যেমন প্রথম আলোতেই এসেছে যে পান, সুপারি, শুকনা মরিচ উৎপাদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। এই ছোট্ট একটা দেশ হয়েও আমরা বিশ্বে দ্বিতীয়, তাহলে আমার বিকাশ ঠেকায় কে। সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যেও এই বাংলাদেশের দুজন বিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে পরিচিতি ও স্বীকৃতি পেয়েছেন, তাতে তো বলাই যায়, আমাদের বিকাশ কে ঠেকাবে। এ রকম আরও উদাহরণ আছে। এই স্লোগানে আসার আগে আমরা আমাদের ব্র্যান্ড ইকুইটি নিয়ে গবেষণা করেছি। দেখতে চেয়েছি, দেশের মানুষের সঙ্গে এই ব্র্যান্ডের সম্পর্ক কী। তাতে দেখেছি যে আমাদের সেবার মানের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে একটা গভীর সম্পর্ক আসলে আমরা গড়ে তুলতে পেরেছি। এতে আমরা অনেক বেশি উৎসাহিত হয়েছি। বিকাশ কেবল মুনাফাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নয়; বরং এই দেশের মানুষের ডিজিটাল লেনদেনের সঙ্গেও বিকাশের যুক্ততা আছে। দেশ তো এগিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় বিকাশ যদি নির্ভরযোগ্য সেবা দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারে, সেটাই অনেক বড় বিষয়। আমরা একটা বাণিজ্যিক কোম্পানি। কিন্তু আমরা তো মানুষের সময় ব্যবস্থাপনায় অনেক সহায়তা করছি। জীবনকে সহজ করে দিচ্ছি। এর তো একটা মূল্য আছে। তাহলে এসব মানুষের বিকাশ ঠেকায় কে। আর বিকাশ এমন এক দারুণ শব্দ, যাকে নানাভাবে ব্যবহার করার সুযোগ আছে। বিকাশ যিনি ব্যবহার করেন, তিনি যে নিজের ভেতরে একটা অন্তর্নিহিত শক্তি অনুভব করেন, সেটাই ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি।

১২ বছর হলো আমাদের, অর্থাৎ একটা যুগ পার করলাম। মানুষ বিকাশকে গ্রহণ করেছে। আমরা সৎভাবে কাজ করছি, সঠিক সময়ে কর জমা দিচ্ছি, ভালো কাজ করছি বলে বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগ করছেন, একটা স্বচ্ছ ও সৎ পরিবেশের মধ্য থেকে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হয়েও দেশের মৌলিক জায়গায় কাজ করার সুযোগ পাচ্ছি, এটা খুবই আশাব্যঞ্জক একটি বিষয়।

বিকাশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল কাদীর
বিকাশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল কাদীর

ব্যক্তিগতভাবে আপনি কতটা সন্তুষ্ট, যা করতে চেয়েছিলেন, তা পেরেছেন?

কামাল কাদীর: আমি যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটিতে (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) গিয়েছিলাম কিছুদিন আগে। তখন শিক্ষকেরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি যে পাস করে চলে গেলে, তারপর কী করলে?’ আসলে ছোটবেলা থেকেই আমাকে প্রশ্ন করা হতো, আমি কী পড়তে বা কী করতে চাই। বলতাম, আগে আমেরিকায় যাই, তারপর দেখা যাক, কী পড়ি। আমেরিকায় গিয়ে বলেছি, অর্থনীতি পড়ছি, পাস করে নিউইয়র্কে যাই, এরপর দেখা যাক, কী করি। তারপর চাকরিও শুরু করলাম। তখন আবার প্রশ্ন করেছেন, কী করতে চাই। তখন বলেছি, আমি বাংলাদেশে ফিরতে চাই। তখন আমার একটি অতি সাধারণ উপলব্ধি হলো যে আমার জায়গা আসলে বাংলাদেশ। আমি এখানেই কাজ করতে চাই। সেই যে উপলব্ধি, আমার জীবনে সেটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। তারপর আমি এখানে ফিরে এলাম। আমি মনে করি, এটা আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল। আমি এতে খুবই খুশি।

সবশেষে বলি, এখনো বাংলাদেশে অনেক কিছু করার আছে। কিছু করে ফেলেছি, তা বলব না, তবে আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, সৎভাবে, সম্পূর্ণ স্বচ্ছ থেকে বাংলাদেশে একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো যায়, বিকাশ এর বড় একটি উদাহরণ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.