যেভাবে প্রতারণার ফাঁদে পড়েন বঙ্গবাজারের কিছু ব্যবসায়ী

0
178
বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের পর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা অস্থায়ী চৌকি বসিয়ে কয়েক দিন বেচাকেনা চালান

দিন দশেক আগে বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী বাবু শেখের মুঠোফোনে একটা কল আসে। বলা হয়, সিটি করপোরেশন থেকে এক লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে তাঁকে। কিন্তু এই টাকা কোনো ব্যাংক হিসাবে নয়, দেওয়া হবে ক্রেডিট কার্ডে। বাবু শেখ প্রথমে বিশ্বাস করতে না চাইলেও, তাঁর দোকান নম্বর, দোকানের কর্মচারীর সংখ্যা, কত টাকার মালামাল পুড়েছিল—এসব তথ্য হুবহু জানায় প্রতারক চক্র। এতে তাঁর ফোনদাতার ওপর বিশ্বাস তৈরি হয়।

বঙ্গ আদর্শ ইউনিটের দোতলার ৪ নম্বর দোকানের ব্যবসায়ী বাবু শেখ পরের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘পরিচিত এক বড় ভাইয়ের ক্রেডিট কার্ড ছিল। ওনার কার্ডের তথ্য দেওয়ার পর সেখান থেকে ৯৪ হাজার ৪০০ টাকা কেটে নেওয়া হয়। দোকান পুড়ে যাওয়ার পর সাহায্যের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়েছি। এখনো ব্যবসা শুরু করতে পারিনি।’

তিনি আরো বলেন, ‘এর মধ্যে এক লাখ টাকা সাহায্যের কথা শুনে তা বিশ্বাস করেছিলাম। কারণ, এর আগের কিছু মানুষ এখানকার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সহায়তা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এখন দেখছি, প্রতারণার শিকার হয়েছি। তাতে বড় অঙ্কের অর্থ হারালাম। এখন দোকান চালু করা তো দূরের কথা, উল্টো পরিচিত বড় ভাইয়ের ক্রেডিট কার্ডের দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে।’

সরেজমিনে গতকাল রোববার বঙ্গবাজারের অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু বাবু শেখ নন, এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন ২০ থেকে ২৫ জন ব্যবসায়ী। আর প্রতারক চক্র থেকে ফোন এসেছে শতাধিক ব্যবসায়ীর কাছে।

কোরবানির ঈদের আগে ও পরে প্রতারণার এই ঘটনা ঘটেছে। প্রতারণার শিকার ব্যবসায়ীদের অনেকে লজ্জায় এ বিষয়ে মুখও খুলছেন না। আর প্রতারক চক্র সিটি করপোরেশনের কথা বলায় অনেকে ভয়ে কথা বলছেন না।

প্রতারণার শিকার হামদু গার্মেন্টসের মালিক মশিউর রহমান বলেন, ‘আমার কাছে ফোন আসে উপসচিব একরামুজ্জামান পরিচয়ে। দোকানের বিস্তারিত তথ্য জানানোর পর আমিও আলাপ করতে থাকি। প্রায় ২০ মিনিট কথা হয়। এরপর আমি আমার ব্যাংকের ডেবিট কার্ডের তথ্য দিই। পরে দেখি, সেখান থেকে ৩০ হাজার টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে। আর্থিক একটু সহায়তার আশায় উন্মুখ হয়ে থাকায় বুঝতে পারিনি আমাদের নিয়ে এমন প্রতারণার ঘটনা ঘটবে।’

প্রতারক চক্রের কাছ থেকে ফোন পেয়েছেন এমন ৪০ ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একেক সময় একেক পরিচয়ে প্রতারকেরা ফোন দিয়েছেন এসব ব্যবসায়ীকে। কখনো পরিচয় দেওয়া হয় আসাদুজ্জামান, কামরুজ্জামান, একরামুজ্জামন, মোজাম্মেল ইত্যাদি নামে। বেশির ভাগ ফোন এসেছে বিকেল ও সন্ধ্যায়।

অনেক ব্যবসায়ী সন্ধ্যার পর ফোন আসায় সন্দেহ প্রকাশ করলে প্রতারকেরা তাঁদের জানান, সিটি করপোরেশনের এই শাখা সন্ধ্যায়ও খোলা রাখা হয়েছে সহায়তার কাজে।

প্রতারণার বিষয়টি কয়েক দিনের মধ্যে জানাজানি হয়ে যাওয়ায় প্রতারক চক্র কিছুটা সতর্ক হয়ে যায়। বঙ্গবাজারের আনাস গার্মেন্টসের মালিক আবদুস ছাত্তার গতকাল বলেন, ‘গত সোমবার বেলা তিনটার দিকে আমার কাছে এ ধরনের একটি ফোনকল আসে। শুরুতেই আমি বিষয়টি বুঝতে পারি। তাই গালিগালাজ শুরু করায় তারা ফোন রেখে দেয়। এরপর বেশ কয়েকবার ওই নম্বরে কল করেছি, কিন্তু সেটি বন্ধ পাই।’

প্রতারণায় ব্যবহৃত একটি নম্বর গতকালও সচল ছিল। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সেই নম্বরে ফোন দিয়ে সহায়তার বিষয়টি নিয়ে কথা বলা হয়। কিছুক্ষণ কথা বলার পর কল কেটে ফোনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

জানা গেছে, বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত যেসব ব্যবসায়ীর কাছে প্রতারক চক্র ফোন করেছে,সবাইকে এক লাখ টাকা আর্থিক সহায়তার কথা বলা হয়। প্রতারক চক্রটি ব্যবসায়ীদের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের তথ্য মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা দুটি প্রতিষ্ঠানের ‘অ্যাডমানি’ অপশন ব্যবহার করে টাকা সরিয়ে নেয়।

ব্যাংকের কার্ড থেকে মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের অ্যাপসে অ্যাডমানি করতে শুধু কার্ডের নম্বর ও গোপন কয়েকটি তথ্য লাগে। সেসব তথ্যই কথার ছলে সংগ্রহ করে নেন প্রতারকেরা।

প্রতারণার বিষয়টি নজরে আসার পর সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানানো হয়েছে বলে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম জানান। তিনি বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রকেও বিষয়টি জানানো হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ প্রশাসনও এ ব্যাপারে অবহিত। তবে এ বিষয়ে প্রতারণা শিকার ব্যক্তিদের কেউ কোনো মামলা করেননি।

গত ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি ইউনিটে (বঙ্গবাজার, গুলিস্তান, মহানগরী ও আদর্শ) মোট দোকান ছিল ২ হাজার ৯৬১টি। এ ছাড়া আশপাশের মার্কেট মিলিয়ে ৩ হাজার ৮৪৫টি দোকানে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে বঙ্গবাজারে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩০৩ কোটি টাকার।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র মো. শহিদ উল্লাহ বলেন, ‘বিষয়টি এখনই জানলাম। তবে সিটি করপোরেশন থেকে অর্থসহায়তার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে, সেটা সবাইকে জানিয়েই করা হবে। আর কোনো অভিযোগ এলে আমরা তা খতিয়ে দেখব।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.