যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদা অঙ্গরাজ্যের লেক তাহো। ২০০৬ সালের জুলাইয়ে এই লেকের পাড়ে আয়োজন করা হয়েছিল এক গলফ টুর্নামেন্টের। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তখনো রাজনীতিতে অতটা পরিচিত নন। মানুষের কাছে তখন তিনি আবাসন ব্যবসার মোগল। টেলিভিশন রিয়েলিটি শো তারকা হিসেবেও ছিলেন বিখ্যাত। ওই টুর্নামেন্ট চলাকালে ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল সাবেক পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের।
দুজনের ওই সাক্ষাৎ এবং এর পরে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার জেরে নতুন এক ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছেন মার্কিনরা। গত বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কের আদালতে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছেন ট্রাম্প। নতুন ইতিহাস বলা হচ্ছে এ কারণে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সাবেক কোনো প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এ ধরনের অপরাধের অভিযোগ আনা হলো। ট্রাম্পকে আত্মসমর্পণ করতেও বলা হয়েছে। বলতে গেলে, তাঁর গ্রেপ্তার এখন অনিবার্য।
স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে ট্রাম্পের ওই সাক্ষাতে কী হয়েছিল, পরে কোন ঘটনার জেরে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চটলেন তিনি, আর এ নিয়ে ট্রাম্প কী বলছেন, চলুন দেখে নেওয়া যাক একনজরে।
লেক তাহোয় সাক্ষাৎ
স্টর্মি ড্যানিয়েলসের আসল নাম স্টেফানি ক্লিফোর্ড। ২০১৮ সালে স্মৃতিচারণামূলক একটি বই লিখেছিলেন তিনি। ওই বইয়ে নেভাদায় ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের ঘটনার আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছেন তিনি। তখনকার একটি ছবিও সামনে এসেছে। ছবিটিতে দেখা যায়, পর্নো সিনেমার একটি স্টুডিওতে একসঙ্গে রয়েছেন ট্রাম্প ও ড্যানিয়েলস। ট্রাম্পের মাথায় লাল টুপি, হলুদ শার্ট আর খাকি প্যান্ট। ড্যানিয়েলস পরেছিলেন কালো টপস।
২০০৬ সালে নেভাদায় দুজনের সাক্ষাতের সময় ট্রাম্পের বয়স ছিল ৬০ আর ড্যানিয়েলসের ২৭ বছর। এর মাস চারেক আগেই ট্রাম্পের তৃতীয় স্ত্রী মেলানিয়া ছেলে ব্যারনের জন্ম দেন। নিজের বইয়ে ড্যানিয়েলস লিখেছেন, নেভাদায় থাকাকালে ট্রাম্পের একটি বাসায় তাঁকে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। নিজের এক দেহরক্ষীর মাধ্যমে তাঁকে ওই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি।
এরপর কী হয়েছিল, তা-ও বইয়ে লিখেছেন ড্যানিয়েলস। ট্রাম্পের সঙ্গে নাকি তাঁর যৌন সম্পর্ক হয়েছিল। বইয়ে ট্রাম্পের শারীরিক গড়ন নিয়েও নেতিবাচক বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। ড্যানিয়েলস আরও লিখেছেন, ওই ঘটনার পর বছরজুড়ে ট্রাম্পের সংস্পর্শে ছিলেন তিনি। তাঁর আশা ছিল, এর বিনিময়ে ট্রাম্প নিজের রিয়েলিটি শোতে তাঁকে নেবেন। তবে এমনটি আদৌ ঘটেনি।
বইয়ে স্টর্মি ড্যানিয়েলসের এসব দাবি মানতে অবশ্য নারাজ ট্রাম্প। তাঁর পাল্টা দাবি, সাবেক এই পর্নো তারকার সঙ্গে তাঁর কখনোই যৌন সম্পর্ক হয়নি। ড্যানিয়েলসই বরং জোরজবরদস্তি করে তাঁর কাছ থেকে অর্থ আদায় করেছিলেন।
মুখ বন্ধ রাখতে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার
২০০৬ সাল থেকে এবার বেশ কিছুটা সামনে এগোনো যাক। ২০১৬ সাল। রিপাবলিকান পার্টির হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ছেন ট্রাম্প। তখন দ্য ন্যাশনাল এনকোয়ায়রার নামে একটি সংবাদপত্রের নজরে আসে, ট্রাম্পের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টায় রয়েছেন স্টর্মি ড্যানিয়েলস।
ওই সংবাদপত্রের মালিক ছিলেন ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ। তিনি ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী মাইকেল কোহেনের সঙ্গে ড্যানিয়েলসের পরিচয় করিয়ে দেন। কোহেন এখন ট্রাম্পবিরোধী হিসেবে পরিচিত। তাঁর ভাষ্যমতে, ২০০৬ সালের যৌন সম্পর্কের কথা চেপে যাওয়ার বিনিময়ে ড্যানিয়েলসকে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার (১০৭ টাকা হিসাবে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা) ঘুষ দিয়েছিলেন ট্রাম্প।
অর্থের বিনিময়ে মুখ বন্ধ রাখতে ছদ্মনামে একটি চুক্তি করেছিলেন ট্রাম্প ও ড্যানিয়েলস। সেখানে ট্রাম্পের নাম ডেভিড ডেনিসন ও ড্যানিয়েলসের নাম পেগি পিটারসন বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
চুক্তিপত্রটি তৈরি করেছিলেন আইনজীবী মাইকেল কোহেন। সেটি আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে।
দুই পক্ষের মধ্যে ওই চুক্তির বিষয়টি ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সামনে আনে মার্কিন গণমাধ্যম দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। এরপর ট্রাম্পের সঙ্গে করা তথ্য গোপন করে চুক্তি বাতিল করতে আদালতে আবেদন করেন ড্যানিয়েলস। ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করার মূলে রয়েছে এই অর্থ লেনদেন। এতে নির্বাচনী প্রচার তহবিল আইনের সম্ভাব্য লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
স্টর্মিকে ঘুষ দেওয়ার ঘটনায় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ছিল নিউইয়র্ক সিটির ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি আলভিন ব্র্যাগের ওপর। বিষয়টি তদন্তের জন্য তিনি গ্র্যান্ড জুরি গঠন করেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে এ জুরি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সিদ্ধান্ত জানায়।
ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। কারণ, ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি আলভিন ব্র্যাগ একজন ডেমোক্র্যাট। তাঁকে ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে সরাতেই এ পরিকল্পনা করা হয়েছে।
২০০৬ সালে নেভাদায় দুজনের সাক্ষাতের সময় ট্রাম্পের বয়স ছিল ৬০ বছর। ড্যানিয়েলস তখন ২৭ বছরের তরুণী। এর মাস চারেক আগেই ট্রাম্পের তৃতীয় স্ত্রী মেলানিয়া ছেলে ব্যারনের জন্ম দেন।
দুর্নাম রটাতে ব্যস্ত ড্যানিয়েলস
চুক্তির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর থেকে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেন স্টর্মি ড্যানিয়েলস। এখনো আদালত ও আদালতের বাইরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রাম্পকে বিদ্রূপ করে নানা বক্তব্য দিচ্ছেন তিনি। যেমন টুইটারে ট্রাম্পকে ‘ছোট্ট’ হিসেবে সম্বোধন করেছেন ড্যানিয়েলস। এমনকি অপমান করে ‘ঘোড়ামুখী’ বলে ডেকেছেন তিনি। দেশের বিভিন্ন স্ট্রিপ ক্লাবেও দেখা গেছে তাঁকে। ক্লাবে তাঁর এই যাতায়াতের নাম দেওয়া হয়েছে ট্রাম্পের নির্বাচনী স্লোগানকে বিদ্রূপ করে। ট্রাম্পের স্লোগান ছিল, ‘আমেরিকাকে আবার মহান করো’।
গত বৃহস্পতিবার ট্রাম্পকে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত করার পর একটি টুইট করেছেন ড্যানিয়েলস। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘আমার কাছে এত খুদে বার্তা আসছে যে আমি জবাব দিতে পারছি না…আর আমি শ্যাম্পেনও ছিটাতে চাই না।’