বেতন দিতে না পেরে স্কুল ছেড়েছিলেন, ৬১ বছর পর দিলেন সেই বেতন

0
95
ঝিনাইদহের শৈলকুপার সোহরাব আলী ৬১ বছর পর বকেয়া বেতন দিতে বিদ্যালয়ে যান

সোহরাব আলী ১৯৬২ সালে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ফুলহরি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। সেই সময় বিদ্যালয়ে তাঁর চার মাসের বেতন বকেয়া পড়ে। বেতন দিতে না পেরে দরিদ্র পরিবারের সন্তান সোহরাব স্কুল ছেড়েছিলেন। পড়ালেখা ছেড়ে কাজ শুরু করেন। ৬১ বছর পর তিনি গত মঙ্গলবার সেই বকেয়া পরিশোধ করেছেন।

সোহরাব আলীর বয়স এখন ৭৫ বছর। জীবনের এই সময়ে এসে তাঁর বকেয়া বেতনের কথা মনে পড়ে। তিনি ছোটবেলার সেই বিদ্যালয়ে গিয়ে বেতন পরিশোধ করেন। বর্তমানে বাজারমূল্য বেশি থাকায় তিনি একসঙ্গে ৩০০ টাকা জমা দিয়েছেন। তিনি বলেন, তিনি সচ্ছল নন, তারপরও ঋণী থাকতে চান না। এ কারণে ৬১ বছর আগের বকেয়া বেতন পরিশোধ করলেন।

স্ত্রী, দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে সোহরাব আলীর সংসার। থাকেন শৈলকুপা উপজেলার মহম্মদপুর গ্রামে। ছোটবেলায় তিনি পাশের গ্রামের বড়দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতেন। পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ১৯৬২ সালে বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ফুলহরি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। মাত্র ছয় মাস ক্লাস করেছিলেন। পরে আর্থিক অনটনে পড়াশোনা ছেড়ে দেন।

সোহরাব আলী বলেন, তাঁর বাবা দরিদ্র হওয়ায় ঠিকমতো পড়ার খরচ দিতে পারতেন না। বিদ্যালয়ে সেই সময়ে মাসিক চার টাকা বেতন দিতে হতো। তার চার মাসের বেতন বাকি পড়ে যায়। তিনি খুব লজ্জায় পড়ে যান। তখন পড়ালেখা ছেড়ে তিনি বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে পুলিশ সদস্য হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে যশোর পুলিশ লাইনসে কর্মরত থাকার সময় স্বল্প বেতনের কারণে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। বাড়ি এসে ব্যবসা শুরু করেন।

সোহরাব আলীর ভাষ্য, ১৯৭১ সালে দেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে চলে যান। তিনি বেতাই ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। পুলিশের প্রশিক্ষণ থাকায় অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি প্রশিক্ষক হয়ে যান। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন তিনি। পরে দেশ স্বাধীন হলে তিনি বাড়ি এসে আরও ব্যবসা শুরু করেন। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তাঁর নাম আসেনি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন তিনি।

ছোটবেলায় দেখা বিদ্যালয় আর ৬১ বছর পর বড়বেলায় দেখা বিদ্যালয়, কতটা বদল হলো? জানতে চাইলে সোহরাব আলী বলেন, ১৯৬২ সালে তিনি যখন এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তখন ছিল টিনের ঘর। প্রধান শিক্ষক ছিলেন মো. মনিরুজ্জামান সিকদার। তিনি মারা গেছেন। ছোটবেলায় তিনি যাঁদের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন, তাঁদের কারও কথা জানেন না এখন। তাঁর সঙ্গে পড়ালেখা করে পরে যাঁরা এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছিলেন, তাঁরাও অবসরে চলে গেছেন। এখন সব তরুণ শিক্ষক। বিদ্যালয়ে এখন একাধিক বড় ভবন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এত বছর পর নিজের ছোটবেলার বিদ্যাপীঠে এসে পার্থক্যটা ‘রাত ও দিন’ মনে হচ্ছে। সবকিছু এত ভালো লাগছে যে নতুন করে তাঁর বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা হচ্ছিল। তাঁর ভাষায়, ‘মনে হচ্ছিল আবার পড়ালেখা করি, বাচ্চাদের সঙ্গে ছোটাছুটি করি!’

বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী হাদিকুর রহমানের কাছে বকেয়া বেতন দেন সোহরাব আলী। রসিদ কেটে সেই টাকা নিয়েছেন বলে জানালেন হাদিকুর রহমান।

ফুলহরি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লক্ষ্মণ প্রসাদ সাহা বলেন, এই বিদ্যালয় ১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত। সোহরাব আলী ভর্তি হন ১৯৬২ সালে। তিনি বেতন দিতে যখন আসেন, তখন তিনি বিদ্যালয়ের কাজে বাইরে ছিলেন। ৬১ বছর পর বেতন পরিশোধ করতে আসায় উপস্থিত অন্য শিক্ষকেরা খুব খুশি হয়েছেন। জমা রসিদ দিয়ে তাঁর টাকাটা নেওয়া হয়েছে। তাঁর এই কাজে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও মুগ্ধ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.