মোশাররফ করিম–জয়া আহসানদের সাজানোই তাঁর পেশা, পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার

0
10
সিনেমা–নাটকে রূপসজ্জার কাজ করেন মানিক হোসেন

সিনেমা, নাটক, বিজ্ঞাপনচিত্রসহ বিভিন্ন আয়োজনে রূপসজ্জার কাজ করেন কিশোরগঞ্জের মানিক হোসেন। এই কাজের জন্য পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন সামির আলম

মানিক হোসেনের বয়স তখন সবে ১৩ বছর। বাবাকে হারিয়ে দিশাহারা অবস্থা। পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে কাঁধে। কিন্তু গ্রামে রোজগারের তেমন পথ নেই। সেই সময় আরও বিপদে ফেলল ’৮৮–এর ভয়াবহ বন্যা। উপায়ান্তর না পেয়ে একদিন করিমগঞ্জের বাড়ি থেকে ঢাকায় চলে এলেন মানিক।

ঢাকায় আসার অন্য উদ্দেশ্যও ছিল। তাঁদের গ্রামেই ইলিয়াস কাঞ্চনের বাড়ি। নায়কের সঙ্গে দেখা করে যদি কোনো কাজের ব্যবস্থা করা যায়। একে-ওকে ধরে নায়কের সঙ্গে দেখাও হলো। মানিক বলেন, ‘ভয়ে আমি কথাই বলতে পারছিলাম না। পরে অবশ্য বলে ফেলি আমাকে যেন শুটিংয়ে কোনো কাজের ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু ভাই আমাকে বললেন, গ্রামে ফিরে পড়াশোনা কর। শুনে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল।’

এফডিসিতে কাজ করার স্বপ্নটাই ভেস্তে গেল। তবে হাল ছাড়লেন না মানিক। এফডিসির গেটেই ঘুরতে থাকলেন। এদিকে সঙ্গে আনা সামান্য টাকাও শেষ। ঢাকায় থাকা-খাওয়ার কোনো জায়গা নেই। নিউমার্কেটে একটি দোকানে কাজ নিলেন। মন কিন্তু পড়ে থাকল এফডিসিতে। প্রায় দিনই গেটে আসেন। এভাবেই একদিন মামা সম্পর্কের একজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। প্রোডাকশন ম্যানেজারের কাজ করেন এই মামা। তাঁর সহযোগিতায় রূপসজ্জাকর আবদুল মান্নানের সহকারীর কাজ পান মানিক হোসেন। চিত্রনায়ক মান্নার সব সিনেমায় রূপসজ্জাকরের কাজ করেন তখন মান্নান। প্রায় পাঁচ বছর তাঁর সঙ্গে থেকে কাজ শেখেন মানিক।

মোশাররফ করিমের সঙ্গে মানিক হোসেন
মোশাররফ করিমের সঙ্গে মানিক হোসেন, ছবি: মানিক হোসেনের সৌজন্যে

১৯৯৫ সাল থেকে নিজেই অভিনয়শিল্পীদের মেকআপ দিতে শুরু করেন। রূপসজ্জাকর হিসেবে প্রথম সাজান নায়িকা চম্পাকে। শুরুতে রূপসজ্জাকর হিসেবে খুব একটা বেশি কাজ পেতেন না। গুরু মান্নান ছাড়াও আরও অনেকের সহায়তায় টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। এর মধ্যেই মান্না প্রযোজিত লুটতরাজ চলচ্চিত্রে কাজ করার সুযোগ হয়।

‘আগেই মান্নাভাই বলে দিয়েছিলেন জীবনের সেরা কাজ যেন হয়ে থাকে। সেভাবেই প্রস্তুতি নিই। সিনেমায় খল চরিত্রে অভিনয় করেন রাজীব। তাঁর মাথায় চুল থাকবে পাগলদের মতো। নিজেই ৭ দিন ধরে সেই চুল তৈরি করি। দুই পাশে জটা। সেই চুল দেখে রাজীব ভাই সবার সামনে আমার প্রশংসা করে আমাকে দুই হাজার টাকা উপহার দেন। তখন মনে হয়েছিল মেকআপের কাজটা আমি পারব,’ বলেন মানিক।

চলচ্চিত্রে কাজ করতে করতে নাটকেও কাজের সুযোগ পান। তৌকীর আহমেদ, শমী কায়সার, বিপাশা হায়াত, জাহিদ হাসানদের হাত ধরে পরে আর তাঁকে কাজ নিয়ে পেছনে তাকাতে হয়নি। নাটক থেকে আফজাল হোসেনের হাত ধরে বিজ্ঞাপনে কাজ শুরু। পরে অমিতাভ রেজা, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীসহ দেশের সেরা সেরা নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। মোশাররফ করিমের মাধ্যমে ফারুকীর সঙ্গে পরিচয়। এই নির্মাতার টেলিভিশন, পিঁপড়াবিদ্যা, ডুব, শনিবার বিকেল সিনেমায় রূপসজ্জা করেছেন।

চঞ্চল চৌধুরীর সঙ্গে মানিক হোসেন
চঞ্চল চৌধুরীর সঙ্গে মানিক হোসেন, ছবি: মানিক হোসেনের সৌজন্যে

‘যার সঙ্গেই কাজ করেছি, সে–ই আমার কাজ পছন্দ করেছে। এভাবেই আমার কাজ বেড়েছে। সবাই আমাকে কাজ দিয়ে মূল্যায়ন করেছে। অনেক তারকা আমাকে ছাড়া কাজই করতে চায় না। এটা আমাকে সম্মানিত করেছে। সব সময় নতুনত্ব নিয়ে কাজ করেছি। সেগুলোই কাজে ফুটিয়ে তুলতাম। এটাই ছিল আমার বিশেষত্ব,’ বলেন এই রূপসজ্জাকর।

তাঁর কাজের জন্য স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ২০১৬ সালে রুবাইয়াত হোসেনের আন্ডার কনস্ট্রাকশন সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ মেকআপম্যান হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান মানিক। এই মূল্যায়নকে তিনি মনে করেন জীবনের সেরা প্রাপ্তি।

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে উত্থান-পতন থাকলেও কাজ নিয়ে মন খারাপের মতো ঘটনা তেমন নেই। তবে পেশা নিয়ে দুঃখবোধ আছে, ‘বিদেশে রূপসজ্জাকর পেশার সম্মান অনেক। কিন্তু এখানে আগে যা সম্মান ছিল, সেটাও এখন নাই। অনেকেই পেশাটাকে সম্মানই করতে চান না, এটাই কষ্ট দেয়।’

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.