পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোটরসাইকেল উভয় সংকট তৈরি করেছে। এই দ্বিচক্রযানটি চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিলে অন্যান্য যানবাহনে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ে। যানবাহন সংকটে বাড়ে ভোগান্তিও। আবার মোটরসাইকেল অবাধে চললে, গতির কারণে সেটিও হয় মৃত্যুর কারণ। বিভিন্ন খবরের তথ্য বলছে, এবার ঈদের আগে-পরে ছুটির তিন দিনে ৩২ জনের প্রাণ গেছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। অন্যান্য দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২ জন।
সড়কে মৃত্যুতে উদ্বিগ্ন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও। গত বুধবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, এবারের ঈদযাত্রা ছিল স্বস্তির। এত সেতু, এত রাস্তা করা হলো, তারপরও দুর্ঘটনায় ইতিবাচক অগ্রগতি হচ্ছে না। দুর্ঘটনা রোধ চ্যালেঞ্জিং।
প্রতিবছর যাত্রী কল্যাণ সমিতি ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, এবারের ঈদযাত্রার প্রতিবেদন আগামী ১ মে প্রকাশ করা হতে পারে। তিনি বলেন, এবার ঈদযাত্রা যানজটমুক্ত ছিল। ঈদের আগে টানা তিনদিনের ছুটি এবং মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা না থাকায় যানজট হয়নি। অন্তত ৩০ লাখ যাত্রী বাইকে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় গেছেন। এতে যান সংকট এবং যানজট দূর হলেও মোটরসাইকেল-সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েছে।
সমিতির গত বছরের পরিসংখ্যান বলছে, সেবার কোরবানির ঈদের আগে-পরে ১৫ দিনে ৩১৯ দুর্ঘটনায় ৩৯৮ জন নিহত হন। প্রাণহানির এ সংখ্যা ছিল তার আগের সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এসব দুর্ঘটনার ৪৪ শতাংশে মোটরসাইকেলের সংশ্লিষ্টতা ছিল। নিহতদের ৩৪ দশমিক ৮৫ শতাংশের মৃত্যু হয় বাইক দুর্ঘটনায়। তথ্য অনুযায়ী, এবার ঈদের ছুটির তিন দিনে ৭২ শতাংশ প্রাণহানি হয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব বলছে, গত বছর ২ হাজার ৯৭৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩ হাজার ৯১ জন, যা মোট প্রাণহানির প্রায় ৪০ শতাংশ। ওই বছর ৪৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনায় ছিল মোটরসাইকেলের সংশ্লিষ্টতা।
গত কোরবানির ঈদে তীব্র যানজট হয় বঙ্গবন্ধু সেতুর দুই প্রান্তে। সে সময় এক জেলা থেকে অন্য জেলায় মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় যান সংকটে পড়েন লাখ লাখ মানুষ। এক পর্যায়ে ঢাকার অভ্যন্তরীণ রুটে চলা লক্কড়ঝক্কড় বাস, পিকআপ, ট্রাকে করে গ্রামের পথ ধরেন তাঁরা। টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা হয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে রংপুর পর্যন্ত নির্মাণাধীন চার লেন মহাসড়ক (সাসেক-২) প্রকল্পের পরিচালক ড. ওয়ালিউর রহমান জানিয়েছেন, গত বছরের ঈদে এক রাতে ৫৩টি গাড়ি বিকল এবং দুর্ঘটনায় পতিত হয় বঙ্গবন্ধু সেতু এবং উত্তরের পথে। এ কারণে তীব্র যানজট ও ভোগান্তি হয়েছিল। এবার এ ভোগান্তি ছিল না। ঈদের দুই দিন আগে ২০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে রেকর্ড ৮ হাজার ২৩৯টি মোটরসাইকেল পারাপার হয়েছে।
সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, গত ২০ এপ্রিল পদ্মা সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল শুরুর পর গত বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ৭৭ হাজার ৫২৯টি বাইক পারাপার হয়েছে। অর্থাৎ পদ্মা সেতু দিয়ে দিনে গড়ে প্রায় ১৩ হাজার মোটরসাইকেল চলছে।
জানা গেছে, মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা করতে যাচ্ছে সরকার। এর খসড়ায় দুর্ঘটনা রোধে উচ্চগতির বাইকের পরিবর্তে স্কুটি ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে ৫০০ সিসির মোটরসাইকেলকে নিবন্ধন দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিনিয়োগ আকৃষ্টে দেশে মোটরসাইকেল উৎপাদন ও সংযোজনের সুযোগ দিয়ে ২০১৮ সালে সরকার নীতিমালাও করেছে। এ খাতে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে বিভিন্ন কোম্পানি। এতে দাম কম থাকায় মোটরসাইকেল হয়ে উঠেছে সহজলভ্য। সাধারণ মানুষ এই দ্বিচক্রযান কিনছেন। এর মাধ্যমে হচ্ছে কর্মসংস্থান; কিন্তু বাড়ছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি। এ পরিস্থিতির মধ্যেই মোটরসাইকেল উৎপাদক ও সংযোজনকারী কোম্পানিগুলোর ‘চাপে’ উচ্চ সিসির বাইককে অনুমোদন দিতে যাচ্ছে সরকার।
বিআরটিএর পরিসংখ্যান বলছে, গত এক যুগে গড়ে প্রতিবছর পৌনে ৩ লাখ মোটরসাইকেলের নিবন্ধন হয়েছে। করোনার কারণে ২০২০ ও ২১ সালে কমলেও প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে মোটরবাইকের কেনাবেচা। গত বছর ৫ লাখ ৬ হাজার ৯১২টি মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়। সারাদেশে নিবন্ধিত ৫৬ লাখ যানবাহনের মধ্যে ৪১ লাখই মোটরসাইকেল।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক বলেন, মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ৩০ গুণ। মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে; নয়তো দুর্ঘটনা বাড়তে থাকবে। এর বিপরীতে শক্তিশালী করতে হবে গণপরিবহন ব্যবস্থা। মোটরসাইকেলের ওপর নির্ভরতা মানে গণপরিবহনের অকার্যকারিতা।