মেয়েরা যে ফুটবল খেলে, ছোটবেলায় তা–ই জানতেন না ঋতুপর্ণা চাকমা

0
12
ঋতুপর্ণা চাকমার হাতে নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার, ছবি: সংগৃহীত

বরজবাঁশি চাকমার জমিজমা বিশেষ ছিল না। ফসল যা পেতেন, তা দিয়ে সংসার চলত না। রাঙামাটির মগাছড়ি গ্রামের এই মানুষটাকে তাই নিরন্তর সংগ্রাম করতে হতো। বছর দশেক আগে ক্যানসারে বরজবাঁশির সেই সংগ্রামও থেমে যায়। একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে পাঁচ সন্তানকে নিয়ে অথই সাগরে পড়েন তাঁর স্ত্রী বোজপুতি চাকমা। কষ্টেসৃষ্টে কীভাবে যে দিন পার করেছেন, তা শুধু তিনিই জানেন। অবশেষে মেয়ে ঋতুপর্ণা চাকমার হাত ধরে সচ্ছলতার মুখ দেখেছে এই পরিবার। তাঁদের ২১ বছর বয়সী মেয়েটি যে এখন দক্ষিণ এশিয়ার সেরা নারী ফুটবলার।

ঋতুপর্ণাকে পাদপ্রদীপের আলোয় এনেছে সাফ নারী ফুটবল। গত অক্টোবরে কাঠমান্ডুতে নেপালের বিপক্ষে ফাইনালে ৮১ মিনিটে তাঁর জয়সূচক গোল গোটা দেশকে আনন্দে ভাসিয়েছে। কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালাভর্তি ২০ হাজার দর্শককে স্তব্ধ করে দিয়েছিল সেই গোল। ঋতুপর্ণা বলেছিলেন, ‘মনে হয়েছিল আমি আসলে দর্শকদের চুপ করাতে পেরেছিলাম।’

সেমিফাইনালে ভুটানের বিপক্ষে ৭-১ জয়ের প্রথম গোলটাও তাঁর করা। টুর্নামেন্টে চার ম্যাচে দুই গোল করার পাশাপাশি অন্যকে গোল তৈরি করেও দিয়েছেন ঋতুপর্ণা। প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের কাছে হেরে বিদায়ের শঙ্কায় পড়েছিল বাংলাদেশ। ৯১তম মিনিটে শামসুন্নাহার জুনিয়র গোল করে বাংলাদেশকে ১-১ ড্র এনে দেন। ঋতুপর্ণার ক্রস থেকেই আসে সেই গোল। এভাবেই সাফ শিরোপা ধরে রাখতে বড় ভূমিকা রেখেছেন ঋতুপর্ণা চাকমা।

মায়ের সঙ্গে সাফজয়ী ঋতুপর্ণা চাকমা,ছবি: সংগৃহীত

২০২২ সালে বাংলাদেশের প্রথম সাফজয়ী দলেরও অন্যতম সদস্য ঋতুপর্ণা। পরের সাফে বাজিমাত। নেপালের সাবিত্রা ভান্ডারির মতো তারকাদের পেছনে ফেলে বাংলাদেশের পাহাড়ি কন্যার সাফ সেরার তকমা পাওয়া বিশাল এক অর্জন। ২০২২ সাফে সেরা ফুটবলার হয়েছিলেন বাংলাদেশেরই সাবিনা খাতুন। সাবিনা-ব্রিগেডের নয়া তারকা ঋতুপর্ণা এবার মাতিয়ে দিয়েছেন নেপাল। সেখানে তিনি তুমুল জনপ্রিয়। গত সাফে তাঁর খেলা দেখতে মাঠে এসেছিলেন অনেক নেপালি দর্শক। ঋতুপর্ণার সঙ্গে ছবি তুলতে স্থানীয় ফুটবল–ভক্তদের লাইন পড়ে যেত।

অথচ মেয়েরা যে ফুটবল খেলে, ছোটবেলায় তা–ই জানতেন না ঋতুপর্ণা। মগাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম ফুটবলে লাথি মারতে গিয়ে পায়ের নখ উঠে গিয়েছিল। ‘তখন জানতাম না যে মেয়েরাও ফুটবল খেলে। শখের বশে খেলতাম। অনেক ভালো লাগত। কিন্তু নখ উঠে যাওয়ার পর ভেবেছি আর ফুটবল খেলব না,’ পেছনের দিনগুলোর কথা বলছিলেন ঋতুপর্ণা।

তারপরও অনেকটা জোর করেই তাঁকে দিয়ে ফুটবল খেলাতেন শিক্ষকেরা। নির্দিষ্ট করে বলতে হবে স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমার নাম। চাইতেন ছোট্ট মেয়েটি ফুটবল খেলুক। আত্মীয়তার সূত্রে বীরসেন আর ঋতুপর্ণা কাকা-ভাতিজি। কাছাকাছি বাড়ি। বীরসেনের ছোট ভাইয়ের বাসায় এক বছর থেকে পড়াশোনা আর অনুশীলন করেন ঋতুপর্ণা। স্থানীয়ভাবে ফুটবল শেখাতেন শান্তিমনি চাকমা। আর ছায়ার মতো ভাতিজিকে আগলে রাখতেন বীরসেন, দিতেন যাবতীয় আর্থিক সহায়তা।

তখন কি বীরসেন জানতেন একটা রত্নের সন্ধান পেয়েছেন? ফোনের ও প্রান্তে বীরসেনের কণ্ঠে আবেগ ঝরে পড়ে, ‘ঋতু খুব ছোট ছিল। কিন্তু খেলত দুর্দান্ত। প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিভা। তখনই বুঝেছিলাম সে অনেক দূর যাবে। আমার আশা ছিল, একটু যত্নে লালন করা গেলে দেশের জন্য ভালো কিছু হবে। তা–ই হয়েছে। যত দূর পেরেছি, ওর সব খরচ দিতে চেষ্টা করেছি।’

ঋতুপর্ণা চাকমা

ফুটবলের সঙ্গে

ছেলেদের সঙ্গে খেলে ফুটবলের অ আ ক খ শিখেছেন ঋতুপর্ণা। তার আগেই ২০১১ সালে বঙ্গমাতা প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় মগাছড়ি স্কুল আর ঋতুপর্ণার সময় হয় রানার্সআপ।

২০১৬ সালে সাভার বিকেএসপিতে ভর্তি হন ঋতুপর্ণা। প্রতিটি ট্রায়ালেই হন প্রথম। বিকেএসপিতে ভর্তি এবং আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ ৪০-৫০ হাজার টাকা দরকার ছিল। কিন্তু পরিবারের কাছে এত টাকা ছিল না। এবারও এগিয়ে আসেন বীরসেন। এদিক-ওদিক থেকে টাকা সংগ্রহ করেন। বীরসেনের প্রতি ঋতুপর্ণার কৃতজ্ঞতার তাই শেষ নেই, ‘আমি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। স্যার পাশে না থাকলে এত দূর আসতে পারতাম না।’ একটা সময় বিকেএসপিতে ৩-৪ মাসের বেতন বাকি পড়ে। চট্টগ্রামে একটা পোশাক কারখানায় চাকরি করা মেজ বোন কানের দুল বন্ধক দিয়ে তখন টাকা জোগাড় করে দেন। এই মেজ বোনের বেতনের টাকাতেই তখন চলত ঋতুপর্ণাদের সংসার।

ঋতুপর্ণা চাকমা এখন দক্ষিণ এশিয়ার সেরা নারী ফুটবলার

২০১৬ সালেই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ক্যাম্পে সুযোগ পান। ৮-৯ বছরের মধ্যে সাফল্যের শীর্ষে উঠে যান। এই শীর্ষে ওঠার পেছনে আছে অনেক কষ্টের গল্প। রাঙামাটির প্রত্যন্ত এলাকা থেকে বাধা জয় করে এগিয়ে চলার গল্প। আর্থিক বাধার দেয়াল টপকানোর গল্প। এর মধ্যেই ২০২২ সালে বিদ্যুৎস্পৃস্ট হয়ে মারা যায় ছোট ভাই পার্বণ চাকমা। বড় তিন বোন বাপ্পি, পাম্পি আর পুতুলির বিয়ে হয়েছে।

ছোট বোনকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ফোনের ও প্রান্তে পুতুলির উচ্ছ্বাস, ‘সে-ই আমাদের এলাকায় প্রথম ফুটবলার। আমরা চাইতাম ও ফুটবল আর লেখাপড়া চালিয়ে যাক। তাই আমরা বাধা দিইনি। ছোটবেলায় ঋতুকে বিকেএসপিতে ভর্তি করানোর সামর্থ্য আমাদের ছিল না। ফুটবল বাদ দেওয়ার অবস্থা হয়েছিল। সুযোগ কাজে লাগিয়ে আজ ও আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে।’ সংসারে সচ্ছলতা আনতে ঋতুপর্ণার পরিশ্রমের কথাও তুলে ধরেন বোন, ‘ঋতুপর্ণা এখন সংসারের হাল ধরেছে। ও সব দায়িত্ব পালন করে।’

শুধু কি তা–ই? পড়াশোনাতেও পিছিয়ে নেই ঋতুপর্ণা। ২০২৩ সালে খেলোয়াড় কোটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনে ভর্তি হয়েছেন। ঋতুপর্ণার মনে আজ একটাই দুঃখ, তাঁর এই সাফল্য বাবা-ভাই দেখে যেতে পারল না। তবে নিশ্চয়ই দূর থেকে ঋতুপর্ণার সাফল্য দেখে তাঁরা খুশি।

মাসুদ আলম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.